মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১৫
গণিতশাস্ত্রে বিখ্যাত আরো একজন মুসলিম মনীষী ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি হচ্ছেন ইব্রাহিম ওকলিদেসি। খাওয়ারেযমির পর গণিতশাস্ত্রে তিনি নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করেন।
ডেসিমলস বা দশমাংশের মাধ্যমে ভগ্নাংশের যে হিসাব গণিতশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় ওকলিদেসি তা উদ্ভাবন করেছিলেন। দামেশকের অধিবাসী এই গণিতবিদ তাঁর এই তত্ত্ব হিন্দি হিসাব নামক নিজস্ব বইতে তুলে ধরেন। অবশ্য জীবিতাবস্থায় তিনি তাঁর এই বইয়ের প্রতি কিংবা তাঁর দেওয়া থিউরির প্রতি গণিত চর্চাকারীদের আকর্ষণ বোধ করার বিষয়টি দেখে যেতে পারেন নি। তবে তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৫০০ বছর পর গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানির মাধ্যমে ওকলিদেসির তত্ত্ব বা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় সবার সামনে উঠে আসে।
মুসলিম গণিতবিদরাই সর্বপ্রথম অ্যালজেবরাকে জ্যামিতির ভেতর প্রবেশ করান এবং বীজগণিতের সমীকরণের মাধ্যমে জ্যামিতির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। মূসা বিন শাকের হিজরী তৃতীয় শতাব্দির একজন মনীষী ছিলেন। বিখ্যাত এই মনীষী ছিলেন মুসলমান এবং ইরানের অধিবাসী। তিনি এবং তাঁর সন্তানেরা জ্যামিতি এবং গণিতের ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। এইসব গবেষণামূলক কাজগুলোকে পরবর্তীকালে পশ্চিমা পন্ডিতেরা অনুবাদ করেছেন এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন।মূসার সন্তান বানু মূসা বৃত্তের পরিধি বা আয়তন মাপার জন্যে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বৃত্তের ব্যাস বা ঘনত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে কিংবা জ্যামিতিক গঠনের পরিমাপ করার জন্যেও তিনি ব্যাপক অবদান রেখেছেন।
ইসলামী যুগে গণিতশাস্ত্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এরকম আরো একজন গণিতবিদ হলেন আবুল হাসান সাবেন বিন কুররা। তিনি ছিলেন হাররানের অধিবাসী। ২১১ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সুরিয়ানী ভাষায় কথাবার্তা বললেও তিনি গ্রিক এবং আরবি ভাষায় ব্যাপক দক্ষ ছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি যেসব অবদান রেখেছেন সেগুলো পরবর্তীকালে এক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, নতুন নতুন থিওরি আবিষ্কার করেছেন তাদেরকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, পথের নির্দেশনা দিয়েছে। জ্যামিতি এবং গণিতবিজ্ঞানে বিশেষ করে তিনি বিভিন্ন গঠনের বাইরের আকৃতি পরিমাপ করার চমৎকার সব পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তাঁর বইগুলোতে অর্থাৎ নিজের লেখাতে যেমন তেমনি গ্রিক গণিতবিদদের যেসব বই তিনি আরবি ভাষায় অনুবাদ করেছেন সেগুলোতেও তাঁর সেইসব পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে।
অপর এক মুসলিম গণিতবিদ হলেন আবু সাইদ সেজযি। গণিত শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশে তিনিও ব্যাপক অবদান রেখেছেন। আবু সাইদ সেজযি ছিলেন সিস্তানের অধিবাসী। তিনি হিজরী চতুর্থ শতকের গণিতবিদ ছিলেন এবং আবু রায়হান বিরুনির সমসাময়িক ছিলেন তিনি। বিশেষ করে জ্যামিতিতে তিনি ব্যাপক দক্ষ ছিলেন। স্বয়ং বিরুনি তাঁর লেখায় আবু সাইদ সেজযির নাম উল্লেখ করতে ভোলেন নি। আবু সাইদ সেজযি জ্যামিতির সমস্যাকে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে সমাধান করেছেন। তিনি অন্তত ৪৫টি বই লিখেছেন এবং অসংখ্য ছোটো পুস্তিকা লিখেছেন যার মধ্যে প্রায় ৩৪টি বই-ই গণিতশাস্ত্র বিষয়ক। বাকি বইগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক।
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম মনীষী আবু রেইহান বিরুনির নামটি সবার কাছেই মোটামুটি পরিচিত। ইরানী এই মহান মনীষীর জীবনকাল ছিল হিজরী চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধ। ৩৬২ হিজরীতে তিনি খাওয়ারেযমশাহীদের রাজধানী শহর তাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অত্যন্ত উঁচু মাপের এই লেখক প্রচুর বই লিখে গেছেন। ভূগোল, নক্ষত্র ও গণিতশাস্ত্রের ওপরই তিনি বেশি লিখেছেন। অনুবাদ এভং মূল রচনা মিলে ১৮০ টিরও বেশি বই তিনি লিখেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হচেছ আরবি থেকে ল্যাটিনে অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর বইগুলো অনূদিত হয় নি। বিরুনির বিখ্যাত একটি বই হচ্ছে আততাফহিম। অ্যালজেবরা, জ্যামিতি এবং হিসাব বিজ্ঞানের ওপর লেখা এ বইটি। ত্রিকোণামিতির ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে।
ইসলামী যুগের গণিতবিদদের উদ্ভাবনী ও অর্জনগুলোই গণিত শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। তবে বিখ্যাত মনীষীদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে যাঁর নামটি সর্বাধিক উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ইবনে সিনা। আবু আলি সিনা দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। হিজরী ৩৭০ সালে বোখারার কাছে-বর্তমান উজবেকিস্তানের কাছে-জন্মগ্রহণ করেন। বোখারাতে তিনি যুক্তবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্র পড়েন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি নুহ ইবনে মানসুর সামানীর চিকিৎসা করেন। আবু আলী সিনা ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের পর মানসুর সামানীর রাজকীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশ করার অনুমতি পান। ইবনে সিনা আবু রেইহান বিরুনির মেো কিংবা আবু নাসর ইরাকির মতো মনীষীদের সাথে গণিতশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে মত-বিনিময় করেন, গঠনমূলক বিতর্কও করেন।
মুসলিম এই মহান মনীষী বিশ্ববাসীর জন্যে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই রচনা করে গেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যারা পড়ালেখা করেন কিংবা চর্চা করেন তাদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য মূল্যবান অনেক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। শাফা তাঁর বিখ্যাত আরো একটি বই। এ বইতে গণিত ছাড়াও মিউজিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনা রয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব নিয়েও এ বইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। মুসলিম মনীষীদের মধ্য থেকে আরো যাঁরা গণিত শাসতে্রে অবদান রেখেছেন তাদের মাঝে খাই্য়্যম নিশাবুরির নামটি অবশ্যই উল্লেযেোগ্য। ওমর খৈয়াম নামেই তিনি বেশি পরিচিত। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ এবং ষষ্ঠ শতাব্দির প্রথমার্ধের সবচেয়ে বড়ো গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন ওমর খৈয়াম। মহাজ্ঞানী এই মনীষী সমগ্র ইরানী জাতির গর্ব। বীজগণিত ও সমাধান বিষয়ে তাঁর লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিসাব বিজ্ঞানও তাঁর আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।
আরো যেসব মুসলিম মনীষীর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখেোগ্য তাদের মধ্যে খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির নামটি অবশ্যই উঠে আসবে। গণিত বিষয়ের পণ্ডিত হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতিমান ছিলেন। ইরানের তূস শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গণিত ছাড়াও ইসলামী বিধি-বিধান এবং সাহিত্য বিষয়ের পাঠ তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। তূসের বিখ্যাত ফকিহ এবং মুহাদ্দিস হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। ছোটোবেলায় তিনি নিশাবুরে যান এবং প্রফেসর কামালুদ্দিনের কাছে গণিত শেখেন। ৬৫৭ হিজরীতে মারা'গেতে তিনি যে মানমন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন দেশ এবং জাতির জন্যে তা ছিল খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির অনন্য এক অবদান। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গ্রন্থাগারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই। অবশেষে ৬৭২ হিজরীর ১৮ই জিলহজ্বে বর্তমান ইরাকে অবস্থিত কাজেমাইনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৮