মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১৬
মুসলমানদের মাঝে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শাখাটির চর্চা সবচেয়ে বেশি ছিল তা হলো জ্যোতির্বিজ্ঞান। এই জ্যোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে আজকের আসরে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।
মুসলিম দার্শনিকগণ জ্যোতির্বিজ্ঞানে ইরানী ও ভারতীয় অর্জন বা উদ্ভাবনীগুলোকে কাজে লাগিয়ে অনেক মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। বিভিন্ন প্রকার সোলার সিস্টেম ঘড়ি তৈরি, গ্রহ নক্ষত্রের উচ্চতা ও গতিবিধি নির্নায়ক যন্ত্র অ্যাসট্রোলেইব আবিষ্কার, সময় নির্নায়ক সরঞ্জাম ইত্যাদি মুসলিম মনীষীদের অবদান। মুসলিম মনীষীগণ বহুধরনের অ্যাসট্রোলেইব তৈরি করেন। এগুলোর কার্যক্রম এতো উন্নত মানের ছিল যে ব্যবহারিক দিক থেকে এগুলো বর্তমান যুগের কম্পিউটারের নির্ভুল ফলাফলের সাথে তুলনাযোগ্য। সময় নির্নায়ক বিদ্যা বা ক্রোনোলজি সম্পর্কে মুসলমান বিজ্ঞানীরা যখন ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন তখন ইউরোপে এই সময় নির্দেশক ঘড়ি বা যন্ত্রের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর মাঝে একটি হলো ভূপৃষ্ঠের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের উপায় নিয়ে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো। ইতিহাসের বিচিত্র তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী আব্বাসীয় খলিফা মামুন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আদেশ দিয়েছিলেন ভূপৃষ্ঠকে পরিমাপ করার জন্যে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তখন তাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের বিশেষ করে গ্রিক মনীষীদের রেখে যাওয়া পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে নতুন আরেকটি পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। এই পদ্ধতিটা বেশ আকর্ষণীয় ছিল সবার কাছে। এর কিছুদিন পর আবু রেইহান বিরুনি অ্যাসট্রোলেইব ব্যবহার করে আরো একটি পদ্ধতি আবিষ্কারে হাত দেন। তাঁর এই বিখ্যাত আবিষ্কারটির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে তাঁরই লেখা ভূপৃষ্ঠ পরিক্রমা নামক বইতে।
নক্ষত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে মুসলিম মনীষীদের কাজের সূত্রপাত ঘটে টলেমির বই অনুবাদের মধ্য দিয়ে। তাঁর বইটি অনুবাদের পর এর ব্যাখ্যাধর্মী আরো অনেক বই লেখা হয়। সেইসব গবেষণা থেকে টলেমির দৃষ্টিভঙ্গির কিছু নেতিবাচক দিক বেরিয়ে আসে মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিবেচনায়। তারা টলেমির দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈপরীত্য পোষণ করে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীদের সেইসব মতামত বর্তমানে ‘কোপারনিক-পূর্ব' দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিখ্যাত। টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখাগুলোর বহু অনুবাদ এবং অসংখ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে এগুলোর মধ্য থেকে তিনটি অনুবাদ এবং বেশ কিছু বিশ্লেষণ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। টলেমি পাঠের ফলে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে এস্ট্রোনমিকেল টেবলস তৈরিতে উদ্বুদ্ধ হন এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থৈরি কেরন। নক্ষত্র সম্বন্ধে যথার্থ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার লক্ষ্যেই এইসব চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল এবং চেষ্টাগুলো সফলও হয়েছিল।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মাঝে একটি ছিল সৌরবর্ষের দৈর্ঘ নিরূপণ করা। এ লক্ষ্যে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অবিরাম পর্যবেক্ষণের ফলে মুসলিম বিশ্বে সময় গণনা বিদ্যার উন্নয়ন ঘটে। সৌরবর্ষের ৈদৈর্ঘ গণনা করতে গিয়েই তাঁরা মুসলিম বিশ্বে পঞ্জিকার উদ্ভব ঘটান। জালালী পঞ্জিকাই তার ঐতিহাসিক উদাহরণ। এভাবেই সৌরবর্ষের সময়সীমা বা কালক্ষণ বাত্তানী এবং খযানীর মতো মুসলিম বিজ্ঞানীদের হাতেই নিরূপিত হয়।
এস্ট্রোনমিকেল টেবলস তৈরির জন্যে বারবার পর্যবেক্ষণ চালানোর ফলে নক্ষত্র সম্পর্কে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ নতুন নতুন তথ্য দিতে শুরু করলেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্বেকার ধারণাগুলোতে সমস্যা রয়েছে। মুসলমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ সুষ্ঠু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে টলেমির থিওরিগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন বা সন্দেহের জন্ম দিলেন। ইবনে সিনা তাঁর জযেোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখায় এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনিও মুসলমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতোই টলেমির থিওরির গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। টলেমির থিওরিটি ছিল ‘এই পৃথিবী হচ্ছে সমগ্র বিশ্বের কেন্দ্র।'
টলেমির থিওরিটির ব্যাপারে আরো যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিরোধীতা করেছেন তাদের মধ্যে খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি অন্যতম। তিনিও টলেমির থিওরিটির অনেক ভুলভ্রান্তি তুলে ধরেছেন। টলেমির থিওরিটির মধ্যে ছিলো গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে-তাঁর এই মতামত সম্পর্কে সন্দেহ েোষণ করেন তুসি। নাসির উদ্দিন তুসির এই মতামত মুসলিম বিশ্বের একেবারে পশ্চিম প্রান্ত তথা স্পেনসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞানীগণ অনুমোদন করেন। নাসিরুদ্দিন তুসির পর আবু রেয়হান বিরুনি, ইবনে হিশামসহ আরো অনেক মুসলিম বিজ্ঞানীই টলেমির থিওরির সমালোচনা শুরু করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে কপলার এবং কোপারনিক মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রভাবিত ছিলেন বিশেষ করে খাজা নাসির উদ্দিন তূসির প্রভাব তাদের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছিল।
মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উচ্চতর গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় চিকিৎসা বিদ্যায় তাদেঁর অগ্রগতির পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন আহমাদ বিন আব্দুল্লা.. মারুযি। মারুযি হিজরী ২০৯ থেকে ২২০ সালর পর্যন্ত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণে আত্মনিয়োজিত ছিলেন। চাঁদের পরিক্রমণও নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। আবু আব্দুল্লা.. মুহাম্মাদ বিন জাবের বাত্তানী একজন বিখ্যাত মুসলিম গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন।
হিজরী ২৪৪ সালের দিকে তিনি হাররানে জন্মগ্রহণ করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানগুলো খুবই মূল্যবান। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে তিনি মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মাঝে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আবু রেয়হান বিরুনিসহ মুসলিম অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী জাবের বাত্তানীর দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ভ্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। নতুন চাঁদ দেখার ব্যাপারে তিনি নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি দেন। সূর্যের পরিভ্রমণ সম্পর্কে নিকোলাস যে থিওরি দেন তা সুস্পষ্টভাবেই বাত্তানীর দৃষ্টিভি্গির প্রভাবে প্রভাবিত। বাত্তানীর উদ্ভাবনীগুলো সমগ্র ইরেোপে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।সৌরবিজ্ঞানে রেো যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহা মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন তাদের মধ্যে আবুল ভাফায়ী বুযজানী নাম উল্লেখেোগ্য।
৩২৮ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাগদাদে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা কাজগুলো চালিয়েছিলেন। চন্দ্রগহণের সময় নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আবু রেয়হান বিরুনির সাথে তিনিও সহয়োগিতা করেছিলেন। বুজডানীও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মূল্যবান বহু বই লিখেছেন। এগুলোর মাঝে পূর্নাঙ্গ অ্যাস্ট্রোনমিকেল চার্ট একটি। কী করে দূরত্ব পরিমাপ করা যায়, পাহাড়ের উচ্চতা নির্ণয় করা যায়, নদীর দৈর্ঘ নির্ধারণ করা যায় সেসব যন্ত্র থৈরির দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন এ বইতে। এই যন্ত্র দিয়ে অ্যাসট্রোলেইবের কাজও চালানো যেত।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১২