আগস্ট ২৪, ২০১৭ ২০:৫৩ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-২২

গত আসরে আমরা আপনাদেরকে মুসলিম বিশ্বের একজন নামকরা চিকিৎসাবিদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। তাঁর নাম আবু আলি সিনা, ইবনে সিনা নামেই তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত বই কানুন ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি আকর গ্রন্থ।

মানবদেহ, রোগ-ভ্যঅধি এবং চিকিৎসাসহ ঔষধ নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন এ বইতে। যাই হোক আজকের আসরে আমরা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছেন এমন আরেকজন চিকিৎসাবিদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো।

ইরানী চিকিৎসাবিদদের মাঝে সাইয়্যেদ ইসমাইল জুরজানি নামে একজন বিখ্যাত মনীষী ছিলেন। তাঁর পুরো নাম হচ্ছে ইসমাইল বিন হোসাইন মুহাম্মাদ জুরজানী তবে সাইয়্যেদ ইসমাইল জুরজানি নামেই তিনি বেশি পরিচিত। গোর্গানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি খাওয়ারেযম সফর করেন এবং অবশেষে ৫৩১ হিজরিতে মারভে মৃত্যুবরণ করেন। ইরানী চিকিৎসাবিদ্যায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন ইসমাইল জুরজানী। তিনি ফার্সি ভাষায় চিকিৎসা বিষয়ক যে গ্রন্থ লিখেছেন তা জুরজানীর আগে ছিল একেবারেই বিরল। অন্যভাবে বলা যায় জুরজানীর লেখাগুলো ফার্সি ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক শিল্পকর্মের জন্যে মাইলফলকের মতো। জুরজানীর লেখালেখির মধ্যে ‘খাওয়ারেযমশাহীর সম্ভার' শীর্ষক বইটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই বইটি ফার্সি ভাষায় লেখা চিকিৎসা বিষয়ক একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ‘খাওয়ারেযমশাহীর সম্ভার' আসলে চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ক একটি বিশ্বকোষ। রোগ সনাক্ত করণ, ঔষধ বিজ্ঞান, ভেষজ ঔষধ পরিচিতি এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত মৌলিক দিকগুলো এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়াও এই বইতে স্বাস্থ্যবিধি এবং খাবার গ্রহণের নিয়ম কানুন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা রয়েছে। প্রতি বছরে রক্ত নেওয়া, দাঁতের পরিচর্যাসহ শরীরের আরো যেসব বিষয়ে সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে সেসব বিষয়গুলো ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করা হয়েছে।

খাওয়ারেযমশাহির দশ খণ্ডের ঐ সংকলনটি সে সময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান অবদান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই গ্রন্থগুলো ফার্সি ভাষা থেকে হিব্রু ভাষাতেও অনূদিত হয়েছিল। জুরজানী নিজেও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিশেষ করে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যাসহ আরো বহু বিষয়ের গ্রন্থ ফার্সি এবং আরবি ভাষায় রচনা করেছেন। ইরানী চিকিৎসাবিদদের মাঝে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন বলে মনে করা হয়। খাওয়ারেযমশাহির রচনাকে প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধির দিক থেকে একমাত্র আবু আলি সিনার কানুনের সাথে তুলনা করা যায়। জুরজানীর এই বিশাল সংকলনের বিভিন্ন বিভাগ ইরানে বহুবার ছাপা হয়েছে।

জুরজানী ছিলেন কুতুব উদ্দিন মুহাম্মাদ খাওয়ারেযমশাহের রাজদরবারের চিকিৎসক এবং শহরের খাওয়ারেযম ফার্মেসি ছিল তাঁরই তত্ত্বাবধানে। সিরিয়ার বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ ইবনে আবু উসাইবার বক্তব্য অনুযায়ী এই তথ্য প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেনঃ ‘জুরজানি ছিলেন অনেক বড়ো একজন চিকিৎসক। তিনি অত্যন্ত যোগ্য একজন ব্যক্তি ছিলেন। ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। খাওয়ারেযম ফার্মেসির প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এই পেশাটি ছিল যথেষ্ট উঁচু মানের এবং উচ্চ বেতনের।' স্বয়ং জুরজানি লিখেছেন ফার্মেসিতে পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁর পুরোটা সময় এখানেই কেটে যেত। কারণে তাঁর সংকলনের দশম খন্ড রচনায় বিঘ্ন ঘটেছিল।

কেননা তাঁর কাছে প্রচুর রোগী আসতো চিকিৎসা নেওয়ার জন্যে। সেজন্যে লেখালেখির উপযুক্ত অবসর তাঁর হয় নি। এভাবেই জুরজানি তাঁর ঔষধ তৈরি ও ঔষধ পরিচিতি বিষয়ক বিশ্বকোষটির পরিসমাপ্তি টানেন। ৫০৬ হিজরিতে তিনি তাঁর বিশ্বকোষটির সংক্ষিপ্ত একটি সংস্করণ সুলতান খাওয়ারেযমের সন্তানের হাতে অর্পন করেন। উল্লেখ্য যে জুরজানি ছিলেন তাঁর বিশেষ চিকিৎসক। জুরজানির আরেকটি বিখ্যাত বই হচ্ছে স্মারক। এটিও চিকিৎসাবিদ্যা এবং ঔষধ বিজ্ঞান বিষয়ক একটি আকর গ্রন্থ।

ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নয়নের ফলে বর্ণ কিংবা সীমান্তের কোনো অর্থ হয় না। কেননা আমরা লক্ষ্য করবো মুসলমান মনীষীগণ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যার যার মতো জ্ঞানরাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন। সিরিয়া এবং মিশরেও বহু মুসলিম মনীষী ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিচিত্র অবদান রেখেছেন। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও তাদেঁর বহু অবদানের কথা অনস্বীকার্য। ইবনে নাফিস যিনি আরবি সূত্রগুলোতে আল-কুরাশি নামে বিখ্যাত, তিনি একজন খ্যাতিমান ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ ছিলেন,একইসাথে ছিলেন চিকিৎসাবিদ্যার একজন বড়ো মাপের লেখক। দামেশক শহরের কাছেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দামেশক বিশাল হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা অর্জন করেন। কিছুদিন পর তিনি মিশরে যান এবং সেখানে একইসাথে চিকিৎসাও করেন এবং চিকিৎসাবিদ্যায় শিক্ষকতাও করেন।

চিকিৎসাবিদ্যায় অসাধারণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে অনেক বড়ো বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হন। এই নিযুক্তির ফলে তাঁর জন্যে চিকিৎসকদের বিষয়ে অবদান রাখার উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়। তিনি বিশাল একটি চিকিৎসাকোষ রচনায় হাত দেন। এই চিকিৎসাকোষটির নাম ছিল ‘আশশামিলু ফিস সানাআতিত তাইয়্যেবা'। কথা ছিল তিন শ' খণ্ডের একটি সংকলন হবে এই কোষটি। কিন্তু আশিটি খণ্ড পর্যন্ত তিনি সমাপ্ত করেছিলেন। এগুলোর কিছু কিছু অংশ নয়টি পাণ্ডুলিপিতে সংরক্ষিত আছে।

ঐ নয়টি পাণ্ডুলিপির একটি ইবনে নাফিস কুরাশির নিজ হাতে লেখা। ইবনে নাফিস অন্যান্য মনীষীর লেখা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন গ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও করেছেন। চক্ষু চিকিৎসা সম্পর্কে এবং হুনায়ন ইবনে ইসহাকের লেখা চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ ‘আলমাসায়েলু ফিত তিব'এরও বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ইবনে নাফিস আলমুয়াজ্‌জায নামকক একটি বই লিখেছিলেন। এই বইটির পাঠক ছিল তাঁর লেখা অপরাপর বইয়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। আর গ্রন্থটি ছিল মূলত ইবনে সিনার লেখা আকর গ্রন্থ কানুনের বিশ্লেষণ।

এছাড়াও ইবনে নাফিস শরীরের বিভিন্ন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে এমন মৌলিক কিছু মন্তব্য করে গেছেন বা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে গেছেন যা তিন শতাব্দি পরে ইউরোপ আবিষ্কার করেছে। যেমন তিনি হার্ট সম্পর্কে বলেছেন ডান পাশের হার্ট বাম পাশের হার্টের তুলনায় ছোটো। তিন শ' বছর আগে তিনি এ দৃষ্টিভঙ্গি ভ্যক্ত করে গেছেন। আর এখন ইতালির বিশিষ্ট চিকিৎসক মিগেল সেরভাতু তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইবনে নাফিসের এই আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে কুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা বলে মনে করা হয়।# 

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/২৪