সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭ ১৮:২০ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-২৭

আবু নাসর মুহাম্মাদ ফারাবি হিজরী তৃতীয় ও চতুর্থ শতকের একজন বিখ্যাত দার্শনিক। তিনি ছিলেন ইরানী একজন মুসলমান মনীষী। হিজরী ২৫৯ সালে ইরানের বর্তমান খোরাসান প্রদেশের ফারাব নামক এলাকায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

সেই সময় ইরানের খোরাসান এবং উজবেকিস্তান ছিল মুসলিম বিশ্বের মধ্যে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ফারাবি তাঁর পড়ালেখা শুরু করেন ফারাবে। তিনি তাঁর পারিবারিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই সমকালে প্রচলিত জ্ঞানগুলো অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইরানের এই মহান দার্শনিক তাঁর জীবনের একটা সময় বিচারকাজে কাটিয়েছেন,তবে অল্প পরেই এই দায়িত্ব ছেড়ে দেন এবং দর্শন আর প্রকৃতি জগত নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। পড়াশোনা ছাড়া তাঁর সময় কাটতো না। উচ্চতরো জ্ঞান অন্বেষণে তিনি বাগদাদ সফরে যান। ফারাবি বাগদাদে গিয়ে মানত্বেক বা যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শন নিয়ে পড়ালেখা করেন। ইউহান্না বিন হিলানের মতো শিক্ষকের কাছে তিনি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

ফারাবি গ্রিক ভাষা খুব ভালো জানতেন। সে কারণে গ্রিক দর্শনের প্রভাব পড়েছিল তাঁর ওপর। গ্রিক ভাষা ও দর্শনের সুবাদে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই এরিস্টটলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এরিস্টটলের জীবন ও কর্ম নিয়ে তিনি তাই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও করেছিলেন। সম্ভবত একারণেই তাকেঁ ইসলামী দর্শনের ইতিহাসে দ্বিতীয় শিক্ষক উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল।

গ্রিক দর্শন নিয়ে পড়ালেখা করার পর ফারাবি যে কেবল এই দর্শনের একজন ব্যাখ্যাকারী হিসেবেই প্রসিদ্ধি পান তাই নয় বরং তিনি নিজেই দর্শনকে সমাজে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেও তৎপরতা চালান। বিশেষ করে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে একমাত্র দর্শনের মাধ্যমেই প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া যায়। দর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ধর্ম ও দর্শনের মাঝে সমন্বয় ও সম্পর্ক স্থাপন করা। তাঁর দৃষ্টিতে দ্বীনে মুহাম্মাদি এবং গ্রিক দর্শনের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই। যদি কোনোরকম মতানৈক্য থেকেই থাকে তা একেবারেই বাহ্যিক ব্যাপার,ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেইসব মতানৈক্য দূর করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়,ফারাবি এরিস্টটলের মতোই বিশ্বাস করতেন যে বিশ্ব অনেক প্রাচীন এবং আদিকাল থেকেই তার অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু কোরআনের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্যে তিনি চেষ্টা করেছেন বিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারে আলকোরআনের বক্তব্য এবং এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে সমন্বয় সৃষ্টি করতে। এভাবে ইরানী এই মনীষী এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি আর কোরআন তথা ইসলামের আকিদা বিশ্বাসের মাজে একধরনের সাযুজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। আর এ কারণেই তাকেঁ ইসলামী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্মরণ করা হয়।

ফারাবি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি বিভিন্ন মতের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন। এক্ষত্রে তিনি অতীতের সবাইকে অতিক্রম করে গেছেন। তিনি সমন্বয় প্রচেষ্টার ব্যাপারে বহুদূর অগ্রসর হয়ে বলেছেন যে "দর্শন মূলত একটাই, দর্শনের বাস্তবতা ও সত্যতা নিয়ে যতোই দার্শনিক মতবাদের সৃষ্টি হোক না কেন সেগুলো বিভিন্ন নয়।দর্শনের একত্বে তিনি কঠোরভাবে বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর এই মত প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বহু তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন এমনকি এ প্রসঙ্গে বহু বইও লিখেছেন।

তিনি মনে করতেন দার্শনিক সত্য যদি এক হয় তাহলে মহান দার্শনিকগণ বিশেষ করে প্লেটো এবং এরিস্টটলের মতো দার্শনিকদের চিন্তার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ফারাবি এই দুই গ্রিক দার্শনিকের মাঝে পার্থক্যকে অগভীর বলে মনে করতেন। সেজন্যে প্লেটো এবং এরিস্টটলের মাঝে এবং তাদেঁর দার্শনিক পদ্ধতির মাঝে অভিন্নতা খুজেঁ বের করার চেষ্টা চালিয়েছেন। ফারাবি যদিও তাঁর এই অভিযানে পুরোপুরি সফল হননি,তারপরও অপরাপর মুসলিম দার্শনিকদের জন্যে পথ সুগম করে গেছেন।

নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মুসলিম দার্শনিকদের মাঝে ফারাবি এমন একজন দার্শনিক ছিলেন যাঁর দর্শন রাজনীতির রঙে রঙীন ছিল। আর এ কারণে তাঁর দর্শন বুঝতে হলে তাঁর রাজনৈতিক বিশেষ তত্ত্ব বা আদর্শের সাথে পরিচিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।এ বিষয়টি ফারাবির দার্শনিক চিন্তা উপলব্ধি করার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি রাজনীতি নিয়ে বেশ কটি বইও লিখেছেন। ইসলামী দর্শনের ইতিহাস বিশারদদের অনেকেই মনে করেন ফারাবির দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো রাজনীতি।তাঁর দর্শনের প্রধান লক্ষ্যই হলো রাজনীতি-এরকমক বিশ্বাসও বিশ্লেষকদের মাঝে রয়েছে। মুসলিম এই মহান মনীষী অবশ্য দর্শন ছাড়াও যুক্তিবিদ্যা, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রে ব্যাপক প্রাজ্ঞ ছিলেন।

তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা সত্তরেরও বেশি। এগুলোকে অবশ্য দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো তিনি অন্যদের যেসব বই পুস্তকের ওপর লিখেছেন, অপরটি হলো তিনি নিজে যেসব বই লিখেছেন। তবে তাঁর লেখা বইগুলো ছিল মূলত প্লেটো এবং এরিস্টটলের বইয়ের ব্যাখ্যা, তাদেঁর দর্শন এবং যুক্তি কেন্দ্রিক।তবে তাঁর নিজস্ব বইগুলোতে তিনি তাঁর সমাজ দর্শন তুলে ধরেছেন।ফারাবির লেখা গুরুত্বপূর্ণ একটি বই হলো আরা আহলাল মদিনা ওয়াল ফাযিলা বা "পবিত্র নগরীর অধিবাসীদের অভিমত" ইংরেজিতে বইটির নামকরণ করা হয়েছে The Virtuous City. ফারাবি ইউটোপিয়া বা কল্পিত আদর্শ সমাজের আদলে মানুষের জন্যে আদর্শ শহর চিন্তা করেছেন।

যার বিপরীতে রয়েছে পথভ্রষ্ট সমাজ। ফারাবির দৃষ্টিতে পথভ্রষ্ট বা গোমরাহ সমাজ বলতে বোঝায় এমন এক সমাজকে যেখানকার জনগণ প্রকৃত সত্য ও সৌভাগ্যের সাথে পরিচয় লাভ করে নি এবং যেই সমাজের লোকজন জীবনসত্য বলতে কেবল বস্তুতান্ত্রিক ভোগবিলাসে মত্ত থাকা আর দৈহিক চাহিদা মেটানোকেই বোঝে। ফারাবির দৃষ্টিতে এই শ্রেণীর সমাজ হয় ভোগ-বিলাসের পেছনে ছোটে অথবা ছোটে শক্তির পেছনে। কিন্তু আদর্শ শহর ফারাবির দৃষ্টিতে মানবীয় সৌভাগ্য ও মর্যাদায় উপনীত হবার সোপান। আদর্শ শহর হচ্ছে সুস্থ সবল এমন একটি দেহের মতো যে দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্যে সদা তৎপর থাকে। পরবর্তীকালে তাঁর এই ধারণা থেকে জন্ম নিয়েছে সমবায় চেতনা।মহান এই মনীষী অবশেষে হিজরি ৩৩৯ সালে আশি বছর বয়সে সিরিয়ায় ইহজগত ত্যাগ করেন। তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই ইউরোপে ইংরেজি এবং হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইউরোপের লাইব্রেরিগুলোতে তাঁর বইগুলো সংরক্ষিত আছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৫