ডিসেম্বর ০৭, ২০১৭ ১৭:২৬ Asia/Dhaka

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের এই পর্বে সূরা লুকমানের ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَلَقَدْ آَتَيْنَا لُقْمَانَ الْحِكْمَةَ أَنِ اشْكُرْ لِلَّهِ وَمَنْ يَشْكُرْ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ (12)

“এবং আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজ কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়,(সে আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারে না) আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।" (৩১:১২)  

এই আয়াত থেকে পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে হযরত লুকমানের পরিচয় এবং নিজ সন্তানের প্রতি তাঁর উপদেশবাণী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা থেকে মুফাসসিরগণ মনে করেন, হযরত লুকমান কোনো নবী ছিলেন না। কিন্তু তিনি এতটা ধার্মিক ও জ্ঞানী ছিলেন যে, মহান আল্লাহ তাঁর তাকওয়ায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে হিকমত বা প্রজ্ঞা শিক্ষা দিয়েছিলেন। প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন জ্ঞান ও সূক্ষ্মদৃষ্টি যা ঐশী জ্ঞানভাণ্ডারের সান্নিধ্যে অর্জিত হয়। মানুষের কথা, কাজ ও আচরণে এই প্রজ্ঞার স্পষ্ট ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। বাকশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, ক্ষুধা ও রিপুর তাড়নাকে করায়ত্ব করা, আমানাতদারি, বিনয় ও অনর্থক কাজ থেকে বিরত থাকার মতো কাজের অনুশীলন ধীরে ধীরে মানুষকে প্রজ্ঞা অর্জনের দিকে নিয়ে যায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, মানব ইতিহাসে শুধুমাত্র হযরত লুকমানই হিকমত বা প্রজ্ঞা অর্জন করেননি বরং হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, কথা ও কাজে সত্যনিষ্ঠ সব মুমিন ব্যক্তির পক্ষে আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে এই মহান নিয়ামত অর্জন করা সম্ভব।

হযরত লুকমানের এ উপদেশাবলী মহান আল্লাহ নিজের কথা হিসেবে পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু এসব কথা পিতা লুকমানের মুখ থেকে তাঁর পুত্রের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করার দু’টি উদ্দেশ্য রয়েছে। এক. মানুষ হিসেবে আমরা যাতে আরেকজন মানুষের মুখের কথা শুনে প্রজ্ঞার সঠিক অর্থ বুঝতে পারি এবং দুই. যুগ যুগ ধরে যাতে সন্তানের প্রতি পিতার এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের প্রতি সমাজের বিজ্ঞ লোকের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্ট হয়ে যায়।

সন্তানের প্রতি হযরত লুকমানের উপদেশকে মোটামুটি দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। এক. পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কথা ও কাজে বিজ্ঞচিত আচরণ করা দুই. জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মহান আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। এই দু’টি কাজ করতে পারার যোগ্যতাকেই বলা হয় হিকমত বা প্রজ্ঞা এবং তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত হাকিম বা বিজ্ঞ ব্যক্তি যিনি নিজের জীবনে এই দু’টি উপদেশ বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সে পথ অনুসরণের আহ্বান জানান।

স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি উন্নত পর্যায়ে উপনীত হতে পারা এবং এমন মহান নেয়ামত অর্জন করার জন্য মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হয়। আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিটি নেয়ামতকে তার নির্ধারিত ক্ষেত্রে কাজে লাগানোই হচ্ছে প্রকৃত শুকরিয়া জ্ঞাপন। এটি করা সম্ভব হলে তা হবে মহাসাফল্য এবং যিনি তা করবেন দুনিয়া ও আখেরাতে তার উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথ খুলে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অপব্যবহার করলে সেটি হবে ওই নেয়ামতের প্রতি কুফরি বা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা;  মুখে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেও এই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে না। কারণ, কর্মে অকৃতজ্ঞতা দেখিয়ে মৌখিক শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতার কোনো অর্থ হয় না। বরং এর ফলে যে ক্ষতি হয় তার জন্য ব্যক্তি নিজেই দায়ী থাকে।

এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১. চিন্তা, কথা ও কাজে সত্যনিষ্ঠ ও পবিত্র হতে পারলে সাধারণ মানুষের পক্ষেও আল্লাহর রহমত ও দয়া অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পুথিগত বিদ্যা  না থাকা সত্ত্বেও একজন মানুষ হিকমত বা প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারে।

২. মানুষের ভালো ও মন্দ কর্মের ফল তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করে। একইভাবে ঐশী নিয়ামতের প্রতি শুকরিয়া বা অকৃতজ্ঞতার ফলও মানুষকেই ভোগ করতে হয়।

সূরা লুকমানের ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَإِذْ قَالَ لُقْمَانُ لِابْنِهِ وَهُوَ يَعِظُهُ يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ (13)

“এবং (স্মরণ করুন) যখন লোকমান উপদেশ দেয়ার সময় তার পুত্রকে বলল: হে পুত্র, আল্লাহর সাথে (কোনো কিছুকে) শরীক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সাথে শরীক করা মহা অন্যায়।” (৩১:১৩)

হযরত লুকমান তাঁর সন্তানকে প্রথম যে উপদেশটি দিয়েছেন তা হলো শিরক থেকে বিরত থাকা। বিশ্বাস কিংবা কাজে কখনোই আল্লাহর সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে শরীক করা যাবে না। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে মূর্তি, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র এমনকি পশুর উপাসনা করার প্রচলন ছিল এবং এখনো আছে। অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে মানুষ মনে করে, এসব জীব কিংবা জড় পদার্থগুলো তাদের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে তারা মানুষ ও বিশ্ব পরিচালনায় এসব জীব ও জড় পদার্থকে সৃষ্টিকর্তার অংশীদার মনে করে এবং সে বিশ্বাস থেকে এসবের উপাসনা করে। এমনকি মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী মুমিন দাবিদার এমন অনেকে আছেন যারা শারিরীকভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সামনে মাথা নত না করলেও প্রকারান্তরে শিরক করছেন। তারা সম্পদ ও ক্ষমতার পূজা করছেন এবং এসব অর্জনের জন্য যেকোনো ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতি করতেও কুণ্ঠাবোধ করছেন না।

শিরকের এই মহাক্ষতির পরিণতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত হযরত লুকমান তার উপদেশাবলী শুরু করার আগে নিজ সন্তানকে শিরক থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, শিরক হচ্ছে মহা অপরাধ। এই অপরাধের ফল প্রথমে ব্যক্তির ওপর পড়ে এবং এরপর তা দ্বীনের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই আয়াতের মাধ্যমে সন্তান লালন পালন ও তাদেরকে ধর্মীয় বিশ্বাস শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে পিতামাতার সঠিক কর্তব্য পরোক্ষভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। অবশ্য কে কীভাবে এই উপদেশ সন্তানদের সামনে তুলে ধরবে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জোর করে চাপিয়ে দিতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই অত্যন্ত আদর ও স্নেহের সুরে সন্তানকে উপদেশ শোনাতে ও তার সামনে ধর্মীয় বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয়াদি তুলে ধরতে হবে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১. প্রতিটি মানুষেরই সত্য পথে চলার জন্য উপদেশ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। এর প্রয়োজন এতটা বেশি যে, কখনো কখনো হযরত আলী (আ.) পর্যন্ত তার সঙ্গীদের বলতেন: “আমাকে উপদেশবাণী শোনাও। কারণ শোনায় এমন এক প্রাণশক্তি আছে যা জানায় নেই।”

২. সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে বিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। তা না হলে পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে।

৩. আমরা যেন মনে না করি, সন্তান স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। তাদের দেহ ও মন যাতে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে সেজন্য তাদেরকে সময় দিতে হবে। তাদের সঙ্গে নম্র ও আন্তরিক ভাষায় কথা বলতে হবে এবং তারা যাতে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বড় হতে পারে সেদিকে যত্নবান হতে হবে।#