মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৪৫
ইরানে ইসলাম আগমনের পথ ধরে আরবি ভাষারও আবির্ভাব ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই ইরানের ভাষা ও বর্ণের ওপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সেসময় দারি ফার্সিভাষী ইরানীদের বিশাল একটি অংশ তাঁদের নিজস্ব লেখালেখিতে আরবি বর্ণমালা ব্যবহার করতে থাকেন।
তখন থেকেই ইরানে ফার্সি ভাষা লেখার জন্যে আরবি-ফার্সির মিশ্রণ শুরু হয়। বলা বাহুল্য, সে সময় থেকে বড় বড় অনেক কবি সাহিত্যিকেরও জন্ম হয়। সেরকম কজন বিখ্যাত ইরানী মুসলিম কবির সাথে আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।
ইরানে ফার্সি কবিতার প্রচলন প্রথমবারের মতো শুরু হয়েছিল হিজরি তৃতীয় শতাব্দিতে তাহেরিয়ান এবং সাফারিয়ানের সময় থেকে। এ সময়কার নামকরা কবিদের মধ্যে 'হানজালা বাদগিসির' নাম উল্লেখযোগ্য। বাদগিস প্রাচীন ইরানের খোরাসান অর্থাৎ বর্তমান আফগানিস্তানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ। এখানেই তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে বাদগিসি নামে খ্যাতি লাভ করেন। ইরানের বিখ্যাত কবি নেজামি আরুজি একটি কবিতার বইকে বাদগিসির বলে উল্লেখ করেছেন।তবে হানজালা বাদগিসির কবিতাকেই দারি ফার্সিভাষার প্রথম কবিতার নমুনা বলে মনেকরা ঠিক হবে না কেননা তাঁর আগেও দারি ফার্সি কবিতা লেখা হয়েছে এবং সেইসব কবিতা বেশ সমৃদ্ধও ছিল। বাদগিসির কবিতাগুলোকে হিজরি চতুর্থ শতকের উজ্জ্বল কবিতা সম্ভারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সর্বোপরি হানজালা হলেন হিজরি তৃতীয় শতকের দারি ফার্সি ভাষার কবিদের মাঝে এমন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রযে নক্ষত্রটি দারি ফার্সি কবিতার সুবহি সাদিক থেকেই প্রোজ্জ্বল।
সমকালীন ইরানের বিখ্যাত সাহিত্যিক ও ইতিহাসবিদ ডক্টর জবিহ উল্লাহ সাফা হানজালার আবির্ভাবকালকে হিজরি তৃতীয় শতাব্দির প্রথমার্ধ বলে উল্লেখ করেছেন ।তাঁর কাব্যপংক্তিমালাকে সুসংহত ছন্দোবদ্ধ এবং অলঙ্কার সমৃদ্ধ বলেও মন্তব্য করেছেন। সামানীয় শাসকদের রাজদরবার কবি সাহিত্যিক ও শিল্পী সমাজের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। এটা তৃতীয় শতাব্দির শেষ এবং চতুর্থ শতাব্দির প্রথমদিককার কথা। তাঁরা কবিতার বিস্তার ও বিকাশে বিচিত্র প্রচেষ্টা চালান। এ সময়কার কবিতার চলমান ধারাটি ছিল কাসিদা। কাসিদা এমন ধরনের কবিতা যাতে রাজা বাদশাদের প্রশংসা, উৎসবাদিকে অভিনন্দিত করা, প্রকৃতির বর্ণনা এবং ধর্মীয়, নৈতিক ও দর্শনিক বক্তব্য থাকে।
সামানীয় যুগের এরকম একজন বিখ্যাত কবি হলেন "রুদাকি সামারকান্দি।" রুদাকিকে ফার্সি কবিতার জনক বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর পুরো নাম আবু আব্দুল্লা জাফর বিন মুহাম্মাদ রুদাকি। হিজরি তৃতীয় শতকের শেষ এবং চতুর্থ শতকের প্রথম দিকের একজন নামকরা কবি ছিলেন তিনি। রুদাকি সামারকান্দ শহরের পার্শ্ববর্তী একটি গ্রামে-অর্থাৎ বর্তমান তাজিকিস্তানে-জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি কোরআন মুখস্থ করেছিলেন এবং কবিতা আবৃত্তি করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠ যেহেতু খুব ভালো ছিল সেজন্যে তিনি কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চাও করেছিলেন। সামানীয় বাদশা দ্বিতীয় নাসরের দরবারে রুদাকি নজিরবিহীন সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর কবিতা ছিল সহজবোধ্য, শব্দগুলোও ছিল সহজ সরল,সবাই বুঝতে পারতো। তাঁকে যথার্থই ফার্সি কবিতার জনক বলা হয়। রুদাকিই সর্বপ্রথম মন কেড়ে নেওয়া ফার্সি গযল লিখেছেন। তাঁর কবিতায় হাসি আনন্দ, দুঃখ বেদনা,পরহেজগারি, উপদেশ ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর কল্পনাশক্তি অসম্ভব শক্তিশালী,কবিতার চিত্রকল্পগুলিও অসাধারণ। রুদাকিকে তাই বিশ্ব কবিদের শিক্ষকও বলা হয়। ইরানের এই বিখ্যাত কবির মূল্যবান বহু শিল্পকর্মের কিঞ্চিত নিদর্শন এখনো অবশিষ্ট রয়েছে। এসবের বাইরেও তাঁর একটি মহান কীর্তি হলো "কালিলা ও দিমোনা" কে ফার্সি ভাষায় কবিতার আঙ্গিকে অনুবাদ করা। দুঃখজনক ব্যাপারটি হলো- রুদাকির বাদবাকি সাহিত্যকর্ম অর্থাৎ মাসনাবি কিংবা পংক্তিমালার মতো এই গ্রন্থটিরও সামান্য অংশই কেবল অবশিষ্ট আছে। সেগুলো পর্যালোচনা করলেও খুব সহজেই তাঁর সাহিত্যিক মেধা ও নৈপুণ্যের বিষয়টি অনুমান করা যায়। কবিতার ভেতর বাইরে যেসব বিষয় থাকে যেমন কল্পনাশক্তি, চিত্রকল্প, উপমা রূপক, বর্ণনার প্রাঞ্জলতা, শব্দ প্রয়োগের নৈপুণ্য ইত্যাদি একত্র মিশ্রণ ঘটেছে। রুদাকি এক লাখ থেকে এক মিলিয়ন পংক্তি লিখেছেন বলে মনে করা হয়। তবে বর্তমানে তাঁর হাজার খানেক পংক্তির বেশি দেখতে পাওয়া যায় না। এগুলোও কসিদা, মাসনাবি, চতুষ্পদী সব মিলিয়ে। যাই হোক অবশেষে হিজরি ৩২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
রুদাকি যে বছর মারা গেলেন, ঠিক সে বছরেই জন্ম নিলেন সাসানীয় শাসনামলের পরবর্তী সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হাকিম "আবুল কাশেম ফেরদৌসি।" ইরানের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় তূস শহরের কাছেই তিনি জন্মলাভ করেন। ইরানীদের জাতীয় এবং সর্ববৃহৎ গ্রন্থ "শাহনামা" রচনা করেন তিনি। এই গ্রন্থটিকে ইরানীদের জাতীয়তার সনদ বলে মনে করা হয়। ফেরদৌসি তাঁর শাহনামা রচনা শেষ করে হিজরি ৪০০ সালে শাহ মাহমুদ গজনবি'র খেদমতে হাজির করেন। ফেরদৌসি যে ইসলামি আকিদা বিশ্বাস বিশেষ করে শিয়া আকিদায় বিশ্বাসী ছিলেন তাঁর শাহনামার বহু পংক্তি থেকেই তা বোঝা যায়। ফেরদৌসির সামাজিক বিশ্বাসও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাদশাদের স্বেচ্ছাচারিতায় তিনি অসন্তুষ্ট হতেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম নজিরবিহীন হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
গাযনাবির শাসনামলেই আরো একজন বড় লেখকের ছিলেন। তাঁর কবিতার স্টাইল খোরাসানী স্টাইল হিসেবে বিখ্যাত। এই স্টাইলটি হিজরি তৃতীয় মতকের মাঝামাঝি থেকে হিজরি পঞ্চম শতক পর্যন্ত ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় বৃহত্তর খোরাসান এবং সিস্তানে প্রচলিত ছিল। গাযনাবি আমলে হিজরি পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে আরেকজন বড়ো কবির আবির্ভাব হয়। তাঁর নাম মানুচেহরিয়ে দমগনি। সৃষ্টিজচগতের বিচিত্র রঙ রূপের দৃশ্য আর প্রকৃতির বর্ণনায় দমগনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন। এক্ষেত্রে তিনি এক কথায় অনন্য।কবিতায় বস্তুজাগতিক এবং বিমূর্ত চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁকে ফার্সি সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো কবি বলে মনে করা হয়। চার স্তবকের কবিতা রচনা ছিল তাঁরই আবিষ্কার। তাঁর আগে এই স্টাইলে আর কেউ কবিতা লেখেন নি।
সেলজুকি শাসনামলে অর্থাৎ হিজরি পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকেও বড় বড় অনেক কবির জন্ম হয়েছে।"উরিয়ন"নামে বিখ্যাত বাবা তাহের হামেদানি তাঁদেরই একজন।বাবা তাহের ছিলেন একজন মরমী কবি। তাঁর কবিতার বক্তব্য ছিল একেবারেই সাদামাটা। তাঁর কবিতা এখনো বিভিন্ন ভাষায় অবশিষ্ট আছে।"পরিণতি" তাঁর লেখা অসাধারণ একটি গ্রন্থ। ৪৪৭ হিজরিতে এই খ্যাতিমান কবি মৃত্যুবরণ করেন। ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হামেদানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
এ সময়কার আরেকজন কবির কথা বলে শেষ করবো আজকের আলোচনা। তিনি হলেন "খাকানি শেরভনি"। তাঁকে সুলতানুশ শোয়ারা উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সমকালে শ্রেষ্ঠ কসিদা রচয়িতা ছিলেন তিনি। ফার্সি ভাষার শিক্ষক এবং উন্নত চিন্তা চেতনার অধিকারী ছিলেন খাকানি। "তুহফাতুল ইরাকাইন" নামে তাঁর বিখ্যাত একটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। এ বইতে তাঁর মক্কা এবং ইরাক সফরসহ এসব শহরের মহান ব্যক্তিত্বদের বর্ণনা রয়েছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ৫