সুরা তাহরিমের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
পাপ থেকে তওবা করা তথা মহান আল্লাহর দিকে ফিরে আসার বিষয়ে বক্তব্য এসেছে সুরা তাহরিমের অষ্টম আয়াতে।
মহান আল্লাহ বলছেন:
মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তওবা কর-আন্তরিক তওবা। আশা করা যায়,তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কাজগুলো মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে,যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ নবী এবং তাঁর বিশ্বাসী সহচরদের অপদস্থ করবেন না। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে। তারা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর ওপর সর্ব-শক্তিমান। -
তওবা হচ্ছে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। কেবল আন্তরিক তওবাই পারে পাপী মানুষকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করতে। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ পালনই তওবার উদ্দেশ্য।
বিশ্বনবী (সা)'র হাদিসে বলা হয়েছে প্রখ্যাত সাহাবি মুয়াজ ইবনে জাবাল তওবায়ে নসুহার অর্থ জানতে চাইলে মহানবী (সা) বলেন: এর অর্থ এমন তওবা করা যাতে তওবাকারী আর কখনও গোনাহর দিকে ফিরে যায় না ঠিক যেভাবে দোহন করা দুধ কখনও ফিরে যায় না স্তনে। অর্থাৎ প্রকৃত তওবা পাপীর মনে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে যে তা তার অতীতের পাপের পথে ফিরে যাওয়ার রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এ ধরনের তওবার ফলে অতীতের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায় এবং ব্যক্তির ঈমানও জোরালো হয়। ঈমানের আলো বিচার-দিবসে মুমিনদের জন্য পথকে করে দেয় প্রশস্ত ও আলোকিত।

সুরা তাহরিমের শেষ তিন আয়াতে মু'মিন নারী ও কাফির নারীদের দুই মডেল বা আদর্শকে তুলে ধরা হয়েছে। আসলে এ তিন আয়াতে মুসলমান নারীদেরকে বিশেষ করে মহানবী (সা)'র স্ত্রীদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হচ্ছে যে তাদের উচিত মুমিন বা বিশ্বাসীদের আদর্শ মেনে চলা, পথভ্রষ্ট ও বিশ্বাসঘাতকদের অনুসরণ করা তাদের জন্য ঠিক হবে না। এখানে প্রথমে আল্লাহর ভয়হীন দুই নারীর পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। এ দুই নারী ছিল হযরত লুৎ ও নুহ নবীর স্ত্রী। তারা এ দুই নবীর শত্রুদের সহায়তা করতেন এবং ঘরের গোপনীয় তথ্য শত্রুদের কাছে পাচার করতেন।
সুরা তাহরিমের ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: যারা কাফের হয়েছে তাদের জন্য মহান আল্লাহ নূহ-পত্নী ও লূত-পত্নীর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তারা ছিল আমার দুই ধর্মপরায়ণ বান্দার ঘরে। এরপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করল তাদের সাথে। ফলে নূহ ও লূত তাদেরকে আল্লাহ তা’আলার কবল থেকে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হলঃ জাহান্নামীদের সাথে জাহান্নামে চলে যাও।
-অন্য কথায় নবীর স্ত্রী হয়েও এ দুই নারী কোনো কল্যাণ অর্জন করতে পারেনি।
এরপর দেয়া হয়েছে দু'জন মু'মিন নারীর দৃষ্টান্ত: মহিয়সী নারী ফেরাউনের স্ত্রী হযরত আসিয়া এবং ইমরানের কন্যা হযরত মারিয়াম। ফেরাউন এতটাই খোদাদ্রোহী হয়েছিল যে সে বলত, আমিই তোমাদের প্রতিপালক।
যখন হযরত আসিয়া যাদুকরদের মোকাবেলায় হযরত মুসার মু'জিজা বা অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তখনই তিনি হৃদয়ের গভীর থেকে হযরত মুসার (আ) ওপর ঈমান আনেন। অথচ ফেরাউনের স্ত্রী রানী হিসেবে দুনিয়ার সব ভোগ-বিলাসে ডুবে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী সম্পদের মোহ ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর স্মরণ ও নৈকট্য তথা ঈমানের সুমিষ্টতাকেই বেছে নিলেন। তবে বিবি আসিয়া তাঁর এই ঈমান গোপন রাখতেন।
কিন্তু এক সময় ফেরাউন আল্লাহর প্রতি হযরত আসিয়ার ঈমানের বিষয়টি টের পায় এবং তাঁকে এক আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে দিতে বার বার চাপ দেয়। আসিয়া ফেরাউনের চাপের কাছে নতজানু না হয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমানে অবিচল থাকেন। এ অবস্থায় ফেরাউনের নির্দেশে আসিয়ার দুই পায়ে পেরেক ঢুকিয়ে তাঁকে উত্তপ্ত রোদের মধ্যে ফেলে রেখে তাঁর বুকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় বিশাল এক পাথর। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ মুহূর্তে এই মহীয়সী ও ত্যাগী নারী বলছিলেন:
'হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি ঘর নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।' (সুরা তাহরিম-১১)

মহান আল্লাহও বিশ্বাসী ও অসাধারণ ত্যাগী এই নারীর দোয়া সাথে সাথে কবুল করেন এবং তাঁকে বেহেশতে স্থান দেন। তাঁর প্রবল পরাক্রান্ত স্বামী ফেরাউন ও তার খোদাদ্রোহীতা আসিয়ার ঈমানে বিন্দুমাত্র আঁচড় ধরাতে পারেনি, বরং বিবি আসিয়া বেহেশতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নারীদের পাশে স্থান পেলেন।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, বেহেশতের সেরা চার নারী হলেন, খুয়াইলিদের কন্যা খাদিজা, মুহাম্মাদের (সা) কন্যা ফাতিমা, ইমরানের কন্যা মারিয়াম ও ফেরাউনের স্ত্রী তথা মাজাহিমের কন্যা আসিয়া। আর তাঁদের মধ্যে সর্বকালের সেরা বেহেশতি নারী হলেন হযরত ফাতিমা (সা.আ)।
সুরা তাহরিমের ১২ নম্বর আয়াতে আদর্শ মুমিন নারী হিসেবে হযরত মারিয়ামের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: আর আল্লাহ দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন ইমরান-তনয়া মারিয়ামের, যে তাঁর সতীত্ব বজায় রেখেছিল। এরপর আমি তাঁর মধ্যে আমার পক্ষ থেকে রুহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তাঁর পালনকর্তার বাণী ও কিতাবকে সত্যে পরিণত করেছিল। সে ছিল বিনয় প্রকাশকারীণীদের একজন।
-মহান আল্লাহ'র ইচ্ছায় স্বামী ছাড়াই সন্তানের অধিকারী হন হযরত মারিয়াম। আর এই সন্তান হলেন বিশ্বখ্যাত মহান নবী হযরত ঈসা (আ)। বিবি মারিয়াম ছিলেন অত্যন্ত খোদাভীরু ও উচ্চস্তরের বিশ্বাসী। তিনি অতীতের সব আসমানি ধর্মগ্রন্থকে করেছেন সত্যায়িত এবং সব সময়ই মহান আল্লাহর সব নির্দেশ মেনে চলেছেন। পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর সতীত্ব ও পবিত্রতার প্রশংসা করেছেন বার বার। কুরআনের নানা সুরার আয়াতে এই মহিয়সী নারীর উচ্চতর ঈমান ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে। পবিত্র কুরআনের একটি সুরার নামই হচ্ছে 'মারিয়াম'। একদল নিকৃষ্ট ও বিভ্রান্ত ইহুদি হযরত মারিয়াম সম্পর্কে অশোভনীয় কথা বলে এবং তাঁর সতীত্বকেও সন্দেহপূর্ণ বলে তুলে ধরায় পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাঁকে অত্যন্ত উচু স্তরের মু'মিন ও পবিত্র চরিত্রের অধিকারী বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৬
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন