ইরানে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর (পর্ব-৪)
আমরা আগেই বলেছি, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের এক বড় কারণ ছিল এর কিংবদন্তীতুল্য নেতা ও তাঁর নেতৃত্ব। অলৌকিক বিপ্লবী মরহুম ইমাম খোমেনীকে বোঝা ও জানা ছাড়া তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবকে বোঝা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ইমাম খোমেনী (র)-কে বুঝতে হলে ইরানের সমকালীন ইতিহাস- বিশেষ করে, ইসলামী বিপ্লবের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা জরুরি।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.) একাধারে এমন একটি ঐতিহ্যের উত্তরসূরি ও এই ধারার সফল পূর্ণতাদানকারী যে ধারার আলোকে ইরানের আলেম, জনগণ এবং এমনকি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়েরও সবাইই মুজতাহিদ ফকিহদের আনুগত্য করতেন। কুরআন ও হাদিস থেকে যে কোনো নতুন সমস্যার সমাধান বের করার যোগ্য ইরানের ঐতিহ্যবাহী মুজতাহিদ ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদরা প্রাচীন কাল থেকেই জনগণের বাস্তব সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতেন ও জনগণকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিতেন।

ইমাম খোমেনী (র.) যোগ্যতা ও অবদানের দিক থেকে সমসাময়িক সব মুজতাহিদকে ছাড়িয়ে গেছেন, যদিও অতীতের মুজতাহিদদের আন্দোলনগুলো চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এই ইমামের নেতৃত্বে। এ প্রসঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর হামিদ আলগার বলেছেন: "আয়াতুল্লাহ খোমেনী (র.)'র কাছে যারা গেছেন তারা জানেন যে তিনি মানবাদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি কেবল নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতার এক অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে ইরানে এরূপ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি প্রচলিত মারজা-ই-তাকলিদের তথা অনুসরণযোগ্য আইনবিদের সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্ব নানাভাবে বিপ্লবকে দিয়েছে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গতি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিপ্লব পরিচালনায় তিনি যে অবদান রেখেছেন তা সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে অতুলনীয় এবং সে ভূমিকা পণ্ডিত, দার্শনিক ও আধ্যাত্মবাদী হিসেবে তার পরিচিতিকে ছাড়িয়ে গেছে।’
ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বের ধরণ প্রসঙ্গে মার্কিন অধ্যাপক হামিদ আলগার আরও বলেছেন: ‘আধুনিক যুগের অনেক মুসলমান মনে করেন, দর্শন ও আধ্যাত্মবাদ অবাস্তব, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকায় অপ্রযোজ্য এবং তা এমনি এক অবাস্তব জিনিস যার সাথে মুসলিম ও ইসলামী বিশ্বের বিরাজমান সমস্যার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আয়াতুল্লাহ খোমেনী এ ধারণাকে ভুল বলে প্রমাণ করেছে। বরং তাঁর কাজ এ দুটি ধারার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছে। তিনি যে বিপ্লব করেছেন তা শুধু রাজনৈতিক ও কৌশলগত ব্যাপার ছিল না, আধ্যাত্মবাদের এক অন্তর্নিহিত শক্তির মাধ্যমেও তা নিখুঁত-নির্ভুলভাবে পরিচালিত হয়েছে।’
হামিদ আলগার এ প্রসঙ্গে আরো লিখেছেন: " ইমাম খোমেনী ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন দেশে ফিরে আসেন তখন তিনি সাথে করে কোনো অর্থ-সম্পদ আনেননি। কোনো রাজনৈতিক দল গঠন কিংবা কোনো গেরিলা যুদ্ধও পরিচালনা করেননি। কোনো বিদেশী শক্তির সাহায্যও তিনি নেননি। অথচ এর মধ্যেই তিনি ইসলামী বিপ্লবের তর্কাতীত নেতৃত্বে সমাসীন হলেন।"
ইমাম খোমেনী (র.) গোটা ইসলামের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলতেন। তিনি কোনো ক্ষুদ্র গ্রুপের এমনকি আলেম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবেও কথা বলতেন না। বরং ইসলামের একজন আলেম ও ইরানের একজন নাগরিক হিসেবে যাবতীয় সমস্যার ওপর কথা বলাকে নিজের দায়িত্ব মনে করতেন। তাঁর সব ঘোষণার মধ্যেই দেখা যেত এক স্থায়ী আবেদন। তিনি বলতেন, ইসলামে আলেমদের বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব রয়েছে। তাই তাঁরা শুধু পাঠ্যসূচীর কিতাবপত্র পড়বেন এবং পড়াবেন এটাই তাঁদের দায়িত্ব নয়। মহানবীর (সা.)' হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব আরো অনেক ব্যাপক ও মহান। তাঁরা নবী মুহাম্মাদ (সা)'র উত্তরাধিকারী। লোকজনদের পথ দেখানোর ব্যাপারে তাঁদের দায়িত্বের পরিধি অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। ইমাম খোমেনী শুধু আলেম সমাজেরই প্রতিনিধিত্বমূলক কথা বলতেন না, বরং সমগ্র মুসলিম জাতির উদ্দেশ্যেই তাঁর বক্তব্য ছিল উচ্চকিত।

মোটকথা নবী-রাসূলগণের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী মহান মুজতাহিদ হযরত ইমাম খোমেনী (র.)'র নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের সফলতার মৌলিক কারণগুলো হল-ফকিহ মুজতাহিদদের গতিশীল ইজতিহাদ, ইসলামী আদর্শের অবিকৃত সাংগঠনিক রূপ যা বহুমাত্রিক যোগ্যতাসম্পন্ন আলেমদের নেতৃত্বে সংগঠিত এবং সর্বোপরি ইসলামী পুনর্জাগরণের শ্রেষ্ঠ শহীদ হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)'র শাহাদতের প্রতি ইরানি জনগণের শোক-ভালবাসাকে শক্তিতে পরিণত করে বিপ্লবে প্রাণ সঞ্চার করা। এ তিনটি মৌলিক কারণকে সমন্বিত করে ইমাম খোমেনী (র.) ইসলামী বিপ্লবকে যৌক্তিক পরিণতি দান করেছিলেন। এটা একদিকে যেমন তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য, অন্যদিকে তা ইসলামী পুর্জাগরণের জন্যও সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী ঘটনা।
ইমাম খোমেনী (রহ.) প্রধান দু’টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইসলামী বিপ্লব সফল করেন এবং দেশে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এর একটি হলো- ইসলামভিত্তিক আদর্শ সমাজ গঠন। আর অপরটি হলো- আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা। ইসলাম ধর্মমতে, মুসলমানদের নেতা হবেন ধর্মবিশেষজ্ঞ ও দূরদর্শী এবং সমাজের সুযোগ্য নেতা। ইমাম খোমেনী (রহ.) ছিলেন কেবল আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল নেতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল তার সব কাজের একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি ছিলেন ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে এবং দুনিয়া, আখিরাত, মানুষ এবং সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিষয়ে ঐশী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী । ইমাম খোমেনী মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধির উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ তাকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান এবং অনন্য ও অলৌকিক বা অবিশ্বাস্য সাফল্য। তারই প্রমাণ দেখা গেছে এমন এক ব্যক্তির ডাকে লাখ লাখ ইরানি যুবক বিপ্লবের আগে ও পরে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে ইসলামী বিপ্লবের এক বিশাল মহীরুহে।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/ ৫