এপ্রিল ১৩, ২০১৯ ১৫:২৯ Asia/Dhaka

সুরা মাআরিজ পবিত্র কুরআনের সত্তুরতম সুরা। মক্কায় নাজিল-হওয়া এ সুরায় রয়েছে ৪৪ আয়াত ও দু'টি রুকু।

কিয়ামত বা পুনরুত্থানের নানা দিক ও এই দিবসের পটভূমি এবং সেই দিনে কাফিরদের অবস্থা, ভালো বা সৎ মানুষদের বৈশিষ্ট ও নানা ভালো কাজ- আর এসব কাজের পরিণতি তথা বেহেশতবাসী হওয়া এ সুরার অন্যতম আলোচ্য বিষয়। অন্যদিকে অসৎ মানুষদের বৈশিষ্ট ও তাদের নানা মন্দ কাজ; আর এসবের পরিণতিতে দোযখী হওয়া এবং কাফির ও মুশরিকদের সতর্ক করা ও বিচার দিবস সম্পর্কেও বক্তব্য রয়েছে এ সুরায়।

সুরা মাআরিজের প্রথম দুই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'একব্যক্তি চাইল, সেই আযাব সংঘটিত হোক যা অবধারিত- কাফেরদের জন্যে, যার প্রতিরোধকারী কেউ নেই।'

তাফসীরে সা’লাবীতে এই এক ব্যক্তির ঘটনা তথা সুরা মাআরিজের প্রথম দুই আয়াতের শানে নুযূল বা পটভূমি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, রাসূল (সা.) গাদীরে খুমে হযরত আলী (আ.)-কে নিজ খলিফা ও উম্মতের নেতা ঘোষণা করলেন এবং এ সংবাদ সর্বত্র প্রচার হলে হারিস বিন নুমান তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, 'আপনি আমাদের এ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে আল্লাহ এক ও আপনি তাঁর রাসুল-এই সাক্ষ্য দিতে, আমরা এ সাক্ষ্য দিয়েছি। এরপর আপনি নামাজ, রোজা, হজ, জিহাদ ও জাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন এবং আমরা সেসবও মেনে নিয়েছি। কিন্তু এরপরও আপনি সন্তুষ্ট হননি, এখন এই যুবক আলীকে নিজের স্থলাভিষিক্ত বলে ঘোষণা করলেন। ‘এ ঘোষণা আপনি নিজের পক্ষ থেকে দিয়েছেন,নাকি আল্লাহর পক্ষ হতে?’ রাসূল (সা.) বললেন যে, তিনি তা আল্লাহর পক্ষ থেকে দিয়েছেন। সে নিবেদন করল,‘হে আল্লাহ! তিনি যদি সত্য কথা বলে থাকেন, তবে আমার ওপর শাস্তি নাজিল কর (যাতে এমন দিন দেখতে না হয়)।’ ফলে খোদায়ী শাস্তি নাজিল হয় এবং একটি পাথর তার মাথা দিয়ে প্রবেশ করে নিচ দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপরই নাজেল হয় সুরা মাআরিজের প্রথম দুই আয়াত।

 

কত বড় হতভাগা ছিল এই হারিস বিন নুমান! আলী (আ.)-এর প্রতি বিদ্বেষ তাকে এতটা পাগল করেছিল যে,সে রাসূল (সা.) অথবা আলী (আ.)-কে নেতা বা মাওলারূপে মান্যকারীদের জন্য আযাব কামনা না করে নিজের জন্যই চেয়ে বসল এবং পরিণামে ধ্বংস হয়ে গেল যা হযরত আলীর প্রত্যেক শত্রুর পরিণাম।

সুরা মাআরিজের তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

'তা তথা কাফিরদের জন্য নির্ধারিত খোদায়ী শাস্তি আসবে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে,যিনি সমুন্নত মর্যাদার অধিকারী। ফেরেশতারা এবং রূহ আল্লাহ তা’আলার দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে,যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।'

-এখানে ফেরেশতাদের উর্ধ্বগামী হওয়া বলতে তাদের শারীরিক উর্ধ্বগমনকে বোঝানো হয়নি বরং আধ্যাত্মিক উর্ধ্বগমনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ছুটে যান। তারা কিয়ামত তথা বিচার দিবসে মহান আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। এখানে রুহ বলতে জিবরাইল (আ)-কে বোঝানো হয়েছে। অন্যান্য ফেরেশতার মধ্যে তাঁর বিশেষ মর্যাদাকে বোঝানোর জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিয়ামতের দিনটি হবে দুনিয়ার হিসেবে ৫০ হাজার বছর দীর্ঘ। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন ৫০ হাজার বলতে হুবহু ৫০ হাজার বছর নয় বরং অতি সূদীর্ঘকাল বোঝানোর জন্য এই সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে।

সুরা মাআরিজের অষ্টম ও নবম আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

সেদিন আকাশ হবে গলিত তামা বা ধাতুর মত এবং পাহাড়গুলো হবে ধূনিত রঙ্গীন তুলা বা পশমের মত ছিন্ন-ভিন্ন।

-পশম বা তুলা এমনই যে তা প্রবল বাতাস বা তুফানে এদিক-সেদিকে উড়ে চলে। কিয়ামতের দিন পাহাড়-পর্বতের অবস্থা হবে এমনই পশম বা তুলার মত। সেদিন জাগতিক সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং জন্ম নেবে এক নতুন জগত। সেই জগতে মানুষ নতুন জীবন শুরু করবে।

এরপরের আয়াতে বলা হচ্ছে,কিয়ামত বা বিচার দিবসে মানুষের ভালো ও মন্দ কাজের হিসাব-নিকাশ তথা বিচার এত নিখুঁত ও কঠিনভাবে করা হবে যে সবাই নিজের মুক্তি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়বে। সেদিন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবও পাপের শাস্তি বা বিচার নিয়ে এত ভীত-সন্ত্রস্ত এবং পেরেশান হয়ে পড়বেন যে অন্যদের নিয়ে ভাবনারও সুযোগ তারা পাবেন না।  সেদিন পাপীরা বলবে: হায়! খোদায়ী শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য যদি সন্তান, স্ত্রী ও ভাইকে এবং নিজ গোত্র বা বংশ যা তাদেরকে দুনিয়ায় সব সময় আশ্রয় দিত তাদেরকেও ও এমনকি বিশ্বের সব মানুষকে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়েও যদি আজ মুক্তি পাওয়া যেত!  কিন্তু তাদের মুক্তির জন্য কোনো পথই থাকবে না!

সুরা মাআরিজের ১৯ থেকে ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

(১৯) নিশ্চয়ই মানুষ লোভাতুর ও অস্থির প্রকৃতির সৃষ্ট হয়েছে। (২০) তাকে দুঃখ বা ক্লেশ স্পর্শ করলে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে বা হা-হুতাশ করে(২১) এবং কল্যাণ তাকে স্পর্শ করলে তথা ঐশ্বর্যশালী হলে কৃপণতা করে। (২২) কেবল নামাযীরা ছাড়া (যারা নিয়মিত নামাজ আদায় করে যায়)।

আ’ছমী ‘যায়নুল মুফতী’ নামক পুস্তকে এক দীর্ঘ হাদিস হযরত আলী (আ.) হতে বর্ণনা করেছেন যার একটি বাক্য হল,তিনি বলেছেন,‘আল্লাহর শপথ,আমি না কখনও কুফ্‌রী করেছি,আর না কখনও কোন জিনিসের লালসা করেছি। যেক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেন,মানুষ বড়ই লোভী;এরপর কিছু মানুষকে ব্যতিক্রমের তালিকায় স্থান দিয়েছেন। আল্লাহর শপথ,আমরা ছাড়া অন্য কেউ ব্যতিক্রমের তালিকায় নেই এবং এটা আল্লাহর এক অনুগ্রহ,তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন।’

 

এখানে এটাও স্পষ্ট যে নামাজ মানুষকে লোভ ও কৃপণতা এবং দুঃখ ও বিপদের মুহূর্তে অস্থির হওয়ার মত রোগ আর সুখের সময় কৃপণ হওয়াসহ সব ধরনের মন্দ কাজ ও স্বভাব থেকেও রক্ষা করে। নামাজ মানুষের মনকে করে পবিত্র।  ব্যক্তিত্ব-সম্পন্ন ও খোদাভীরু মানুষ অন্য মানুষের কাছে তার অভাব ও নিঃস্বতার কথা বলে না এবং অন্যের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার আশা করে না। এক্ষেত্রে লজ্জা তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/  ১৩