রমজান: খোদাপ্রেমের বসন্ত (পর্ব-৪)
রমজান আত্মগঠন, আত্মশুদ্ধি ও আত্ম-উন্নয়নের সুবর্ণ সুযোগের মাস। রমজানে পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানাহারসহ অনেক বৈধ আনন্দ ও তৎপরতা থেকে বিরত থাকতে হয়।
আমাদের ভেতর তথা অন্তরকে পবিত্র করার জন্য কেবল শরীরকে পবিত্র করাই যথেষ্ট নয়। শরীরকে সুস্থ, সবল ও সুন্দর রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করার যেমন দরকার হয় তেমনি আত্মাকে সুন্দর, সবল ও সুস্থ রাখার জন্যও আত্মার কিছু ব্যায়াম বা অনুশীলন জরুরি। নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি হচ্ছে এমনই কিছু অনুশীলন।
রোজা বলতে কেবল এটা বোঝায় না যে আপনি কেবল পানাহার ও বিশেষ কিছু জৈবিক তৎপরতা থেকে বিরত থাকবেন। যদি তা-ই হত তাহলে আপনি কখনও কখনও বা কোনো একদিন মহা-ব্যস্ততার কারণে সারা দিনের মধ্যে একবারও পানাহারের সুযোগ পেলেন না বলে সেই দিনটি আপনার জন্য রোজা হয়ে যেত বা রোজার সাওয়াব আপনি পেতেন! কিন্তু না, তা হয় না। কারণ রোজা রাখার জন্য সংকল্প বা নিয়তেরও দরকার রয়েছে।
রোজার প্রকৃত নিয়ত বা সংকল্পের মর্মটা কী? মহান আল্লাহ রোজা রাখাকে ফরজ করেছেন বলে আল্লাহর এই নির্দেশ মানার জন্য এবং খুশি মনে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই রোজা নামক আত্মিক ও দৈহিক অনুশীলনের সংকল্প করা হচ্ছে রোজার নিয়ত করা। আর এই নিয়তের কারণেই আপনার পানাহার বর্জন এত মূল্যবান ও সাওয়াবপূর্ণ হচ্ছে।

রোজা রাখার বিষয়টিকে যদি চাপিয়ে দেয়া ও নিরানন্দময় এবং শাস্তিমূলক কোনো কাজ বলে মনে করা হয় তাহলে আপনার এই অনিচ্ছা ও অনীহা রোজাকে বরবাদ করে দেবে। প্রকৃত মুমিন রমজানের চাঁদ দেখে ঈদের আনন্দ অনুভব করেন। তাই মুমিনরা রোজার মাসের সূচনাতেই একে-অপরকে অভিনন্দন জানান।
রোজা সবচেয়ে ভালো কাজগুলোর অন্যতম। বাহ্যিক দিক থেকে রোজার মানে হল বিশেষ কিছু কাজ না করা। কিন্তু আত্মিক বা আধ্যাত্মিক দিক থেকে আপনি অনেক কাজ করছেন। আপনার সেই রোজার নিয়তের কারণে ফজরের আজান থেকে মাগরিবের আজানের সময় পর্যন্ত আপনার সব কিছুই ইবাদতে পরিণত হয়। আপনি যদি এ সময় ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেন বা নীরব থাকেন কিংবা কেবল শ্বাস-প্রশ্বাস নেন- তাতেও ইবাদত ও আল্লাহর স্মরণের সাওয়াব দেয়া হয়।
রোজা আমাদের এটা শেখায় যে ব্যাপক আরাম-আয়েশ, ভোগ বা পানাহারের মধ্যে মানুষের আত্মার উন্নতি বা মানুষের মর্যাদার কিছু নেই। ব্যাপক পানাহারে যদি তথাকথিত কোনো বীরত্ব থেকে থাকে তাহলে তা তো পশুরও রয়েছে! বরং সংযত ও সংযমী জীবনেই রয়েছে মানুষের মর্যাদা ও বীরত্ব। পরিমিত বা পর্যাপ্ত পানাহার ও আরাম-আয়েশ মানুষের জন্য অবৈধ নয়। অবৈধ বা ধ্বংসাত্মক হল এসবের মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় ডুবে থাকা বা এসব পার্থিব আনন্দের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা। রোজা আমাদেরকে ভোগ আর সংযমের লাল-সীমানা মেনে চলার তথা পাপ থেকে দূরে থাকার প্রশিক্ষণ দেয়।
পবিত্র রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব মুহাম্মাদ মুনির হুসাইন খান বলেছেন:
রমযান মাস অশেষ কল্যাণ ও বরকতের মাসঃ
মহানবী(সা:) বলেছেন: রমযান মাসে যে সব বরকত ও কল্যাণ আছে তা যদি বান্দারা জানত তাহলে তারা কামনা করত যে পুরো বছরটাই রমযান মাস হোক।
পবিত্র হাদিসের আলোকে রোজা হচ্ছে শরীর ও মনের যাকাত তথা শরীর ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। রোজাদারের কান, চোখ, মুখ, জিভ, গোশত, রক্ত, নাক, ত্বক বা চামড়া, চুল-এসবেরও রোজা রাখতে হয়। প্রকৃত রোজাদার হতে হলে মিথ্যা বলা যাবে না, কোনো মুমিন বা মুসলমানকে কষ্ট দেয়া যাবে না, কাউকে ধোঁকা দেয়া যাবে না, মুসলিম সমাজ ও এর কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা যাবে না, কারো ক্ষতি করার ইচ্ছাও করা যাবে না। কারো গিবত করা, কাউকে অপবাদ দেয়া, ওজনে কম দেয়া, পণ্যের বেশি দাম রাখা, বিশ্বাসঘাতকতা করা - এসব রোজাকে বরবাদ করে দেয়। মোটকথা রোজাদার হতে হলে আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে সব পাপ থেকে দূরে থাকতে হবে। হাদিসের আলোকে রোজাদার হতে হলে মানুষকে ফিরে আসতে হবে প্রকৃত মনুষ্যত্বের দিকে তথা যে পবিত্র প্রকৃতিগুলো দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সেইসব পবিত্র স্বভাবগুলোর দিকে। বছরের অন্য মাসগুলোতে যে বেপরোয়া ভাব ও আচরণ দেখা যায় মানুষের মধ্যে সেই একই আচরণ দেখা যায় না রমজানের রোজার প্রভাবেই। তাই রমজানে মুমিনরা হয়ে পড়েন ভিন্ন ধরনের মানুষ তথা উন্নত মানুষ।
রোজা কেবল শরীর ও পেটের বাহ্যিক রোজা নয়। প্রকৃত রোজাদার তার পঞ্চেন্দ্রিয়কে ও প্রবৃত্তিগুলোকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন যে সেসব যে কোনো ধরনের পাপ এড়াতে সদা-সতর্ক থাকে। এভাবে অন্তরকে পরিপূর্ণ স্বচ্ছ ও পবিত্র করাই হচ্ছে আসল রোজা।
জীবনের সময় খুবই সীমিত। আজ নয় কাল, এ বছর থাক্- আগামী বছর, ইবাদত ও সংশোধনের অনেক সময় বাকি আছে- এমন ভাবা ঠিক নয়। দশকের পর দশক, যুগের পর যুগ শেষ হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুর সময় যখন এসে পড়বে তখন মনে হবে-কত দ্রুত শেষ হল আয়ু! মহান আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন প্রস্তুতিবিহীন মৃত্যু এবং আয়ু বা জীবনের দিনগুলোর অপচয় হতে।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/ ৪