রমজান: খোদাপ্রেমের বসন্ত (পর্ব-৯)
আজ আমরা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম সাজ্জাদ তথা হযরত ইমাম জাইনুল আবেদিনের (আ) একটি দোয়ার আলোকে পবিত্র রমজানে আত্মশুদ্ধি সম্পর্কে কিছু কথা বলব। দোয়াটি সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ার ৪৪তম দোয়া।
পবিত্র কুরআন ও মহানবীর হাদিসের পর হযরত আলীর (আ) নাহজুল বালাগা ও ইমাম সাজ্জাদের সহিফায়ে সাজ্জাদিয়া মুক্তির পথ-নির্দেশনা ও খোদা-প্রেমের গাইড হিসেবে অত্যন্ত বরকতময় ও জরুরি দুটি বই। তাই এ দুই বইয়ের সঙ্গেও মুসলমানদের উচিত প্রেমময় সম্পর্ক গড়ে তোলা।
ইমাম সাজ্জাদ (আ)'র আলোচ্য এ দোয়া তাঁর অন্য সব দোয়ার মতই মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রেমময় সংলাপ ও বিনম্রতা এবং আকুলতায় পরিপূর্ণ। আসলে যুক্তি ও প্রেমময় কান্না-ভেজা আকুতিতে তাঁর সব দোয়াই অনন্য।
ইমাম সাজ্জাদ তাঁর এ দোয়ার প্রথমেই বলছেন, মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি এ জন্য যে তিনি আমাদেরকে তাঁর প্রশংসাকারীদের মধ্যে রেখেছেন। আমরা মহান আল্লাহর নেয়ামতগুলো সম্পর্কে গাফেল নই। এসব নেয়ামতের জন্য আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মহান আল্লাহ যদি নানা সুযোগ বা পথগুলো খুলে না দিতেন তাহলে আমরা তাঁর প্রশংসাকারী হতে পারতাম না। এরপর ইমাম সাজ্জাদ এ দোয়ায় বলছেন, আল্লাহর শোকর করছি এ জন্য যে তিনি আমাদেরকে তাঁর দিকে যাবার, পূর্ণতা পাবার এবং দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার মহা-খনিতে যাওয়ার অন্যতম পথ তথা রমজান যা কিনা তাঁরই মাস- তা দান করেছেন।
এখানে দেখার বিষয় হল সব মাস ও দিন মহান আল্লাহর হওয়া সত্ত্বেও এখানে রমজানকে আল্লাহর নিজের মাস বলার অর্থ হচ্ছে এ মাসের প্রতি রয়েছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও গুরুত্ব। )

ইমাম সাজ্জাদের দৃষ্টিতে রমজান হচ্ছে সংযমের ও আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের মাস। এই মাস নাফসের উন্নয়ন বা আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য খুবই মোক্ষম সময়। কারণ ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করাসহ নানা ধরনের প্রবৃত্তিকে দমনের চর্চা করা হয় এই মাসে। মুসলমানরা এ মাসে কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই নানা কষ্ট সহ্য করেন। বছরের অন্য সময়ে তারা ঠিক এত ব্যাপক মাত্রায় নিজেদেরকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেন না। তাই রমজান হচ্ছে আল্লাহর কাছে আত্ম-সমর্পণের মাস।
ইমাম সাজ্জাদ তাঁর এই দোয়ায় রমজানকে পবিত্র করার বা পবিত্রকারী মাস বলে উল্লেখ করেছেন। এ মাসে এমন কিছু মাধ্যম আছে যা মানুষের আত্মাকে পবিত্র করে। যেমন, খোদ রোজা, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, নফল নামাজ ও মহান আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি ইত্যাদি। আর এসবই মহান আল্লাহর অনুগ্রহ বা খোদায়ি ভোজ-সভার কিছু নেয়ামত। এ মাসে মুসলমানরা আল্লাহরই খাস মেহমান।
কুরআনও এ মাসের আরেকটি বড় আধ্যাত্মিক খাবার যা রমজানের খোদায়ি দস্তরখানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। রমজানের এসব খোদায়ি নেয়ামত আমরা যত বেশি ব্যবহার করব ততই আমাদের আধ্যাত্মিক ভিত্তি মজবুত হবে। ফলে মহান আল্লাহ ও পূর্ণতার দিকে সফরের পথ হবে অনেক বেশি সহজ এবং সৌভাগ্যের সোপানও চলে আসবে হাতের মুঠোয়।
এরপর ইমাম সাজ্জাদ (আ) এই দোয়ায় রমজানকে খালেস করার বা আন্তরিক হওয়ার মাস বলে অভিহিত করেছেন। আমাদের সবার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে স্বর্ণের মত মহামূল্যবান রত্ন। কিন্তু নানা উদাসীনতার কারণে এর মধ্যে মিশে গেছে নানা আবর্জনা, ভেজাল ধাতু ও ধুলো-বালিসহ নানা পংকিলতা। সব নবী-রাসুল এসেছেন আমাদের ভেতরের এই অমূল্য রত্ন তথা সোনার আত্মাকে পবিত্র ও খাঁটি করতে। সব ধরনের কঠিন খোদায়ি পরীক্ষা, সাধনা, জিহাদ ও শাহাদাত- এসবের উদ্দেশ্যও হচ্ছে এই পবিত্রকরণ। অন্য যে কোনো মাসের চেয়ে এ মাসে আমাদের আত্মাকে পবিত্র করা অনেক বেশি সহজ।

আমাদের সব পাপাচার, কু-অভ্যাস বা পাপ-প্রবৃত্তি- এসবই আমাদেরকে নিচে নামাচ্ছে। কেবল তওবার নুর ঠেকাতে পারে এইসব অধঃপতন ও বিচ্যুতি। বলা হয় গোনাহ করে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা উচিত এবং আর কখনও তা না করার প্রতিজ্ঞা করতে হবে। তা না হলে মানুষ পাপের চোরাবালিতে ডুবতেই থাকে। পাপ অব্যাহত রাখলে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি হয় যে সেখান থেকে আর ফিরে আসার বা সংশোধনের কোনো উপায় থাকে না। পাপের কাজ ছাড়াও নানা ধরনের কু-অভ্যাস মানুষকে বিচ্যুত করে। বহু মানুষের একটি বাজে স্বভাব হল: আত্মপ্রেম বা কেবল নিজের মতকেই গুরুত্ব দেয়া ও নিজেকে বেশি জ্ঞানী মনে করা। এ ধরনের মানুষ অন্যের ন্যায্য মতামত বা পরামর্শকে গুরুত্ব দেয় না। হিংসার স্বভাবও যদি বদ্ধমূল হয়ে যায় তাহলে মানুষ সুন্দর বিষয়কেও নোংরা রূপে দেখে এবং উজ্জ্বল বাস্তবতাকেও স্বীকৃতি দেয় না। খ্যাতির মোহ, পদের লোভ ও অর্থের মোহ-এসব স্বভাবও মানুষকে সত্য আর বাস্তবতা থেকে দূরে রাখে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এসব মন্দ স্বভাবের ছায়া থেকেও দূরে রাখুন।
পবিত্র রমজানের ফজিলত সম্পর্কে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব মুহাম্মাদ মুনির হুসাইন খান বলেছেন:
মহানবী ( সা: ) বলেছেন: তোমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে মাহে রমযান। এ মাস হচ্ছে বরকতময় ( মুবারক ) .......... এ মাসেই আছে লাইলাতুল ক্বদর ( শব-ই ক্বদর বা মহিমা-রজনী )। ঐ ব্যক্তি আসলেই বঞ্চিত ( মাহরূম) যে এই রাতে বঞ্চিতই থেকে যায় ( অর্থাৎ এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী ও ইস্তিগফার করা ও পাপ বিমোচিত হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থেকে যায় ) ।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/ ৯