পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-২)
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী তার এক ভাষণে পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইলের সমালোচনা করে বলেছেন, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি মানুষের হৃদয় ও মনকে বৈষয়িক করে তুলছে এবং জীবনের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের গণ্ডিকে অর্থ-সম্পদ অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। তারা আধ্যাত্মিক লক্ষ্য ও আদর্শ এবং আত্মিক উৎকর্ষকে পাশ কাটিয়ে পাপাচারকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করছে। এর ফলে পরিবার প্রথা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আজকের আসরে আমরা পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ ভোগবাদ নিয়ে আলোচনা করব।
বর্তমানে ভোগবাদ হচ্ছে পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইলের একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। এই ভোগবাদ পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাকাকে গতিময় করেছে এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে। ভোগবাদকে শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে চলবে না। সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ভোগবাদ মূলত: মানুষকে প্রতিনিয়ত পণ্য ও সেবা গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে ভোগবাদ, পণ্যের উৎপাদনের প্রবণতাকে অতি উৎপাদনের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যেখানে পণ্যের সরবরাহ ভোক্তার চাহিদার চেয়েও বেশি। এ কারণে প্রস্ততকারকরা বিজ্ঞাপনসহ নানা কৌশলে মানুষকে নতুন পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মানুষ তার প্রয়োজনে নয় বরং সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে পণ্য কিনছে বা সেবা নিচ্ছে। ভোগবাদ ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করার কারণে নানা প্রান্তের সমাজ বিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অর্থনীতিবিদ ও মনোবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রখ্যাত লেখক তিম দুশান এ সংক্রান্ত একটি নিবন্ধে ইনফোগ্রাফিক্সের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের লাইফ স্টাইল তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, বর্তমান বিশ্বের মোট সাতশ' কোটি মানুষ যদি এখনই মার্কিনীদের স্টাইলে জীবনযাপন শুরু করে তাহলে এই পৃথিবীতে স্থান সংকুলান হবে না। এ জন্য আমাদের পৃথিবীর আয়তনের চার গুণ জায়গা প্রয়োজন হবে। তিম দুশান আরও লিখেছেন, ভোগবাদী জীবনাচারের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ও পরিসংখ্যান থাকা সত্ত্বেও মানুষ এ বিষয়ে সতর্ক হচ্ছে না। কিন্তু নিশ্চিতভাবে এই জীবনাচার একদিন মানব সভ্যতাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। তিনি লিখেছেন, বর্তমান বিশ্বের মানুষ প্রতি বছর এক হাজার কোটি পশুর গোশত খাচ্ছে, প্রতিবছর এক হাজার ৬০০ কোটি পিস পোশাক-পরিচ্ছদ এবং কেবল একবার ব্যবহার উপযোগী পণ্য ব্যবহার করছে অথবা ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করছে। তার মতে, এই পরিসংখ্যান মানুষের জন্য শুভ ইঙ্গিত বহন করে না।

ভোগবাদ সম্পর্কে অঞ্চলভিত্তিক তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আর পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের মাথাপিছু পণ্যের ব্যবহার বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। মার্কিন নাগরিকদের মাঝে পণ্যের ব্যবহার ও সেবা গ্রহণের প্রবণতা মাত্রাতিরিক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করে, কিন্তু গোটা বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ জ্বালানি খরচ হয় তার ২০ শতাংশ তারা ব্যবহার করে। বিশ্বে মোট যে পরিমাণ মাংস খাওয়া হয় তার ১৫ শতাংশ খান মার্কিন নাগরিকরা। আর গোটা বিশ্বের মোট বর্জ্য ও আবর্জনার ৪০ শতাংশই উৎপাদিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অতীতে মানুষের জীবনাচার ছিল অত্যন্ত সাধারণ। মানুষের প্রয়োজনমতো পণ্য উৎপাদিত হতো। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পুঁজিপতি পণ্য-প্রস্ততকারকদের জন্য বিশাল বাজারের প্রয়োজন দেখা দেয়। তারা কল-কারখানায় মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনকেই সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে থাকে। তাদের অপকৌশলের ফলে আজ ভোগবাদী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
পশ্চিমা পণ্য প্রস্তুতকারীদের সাধারণ সূত্র হলো, পণ্যের ব্যবহার যত বেশি হবে, উৎপাদন তত বাড়ানো যাবে। আর উৎপাদন বৃদ্ধি মানেই বেশি মুনাফা। অন্যভাবে বলা যায়, পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী পণ্য প্রস্ততকারকরা ইচ্ছে করে মানুষের মধ্যে পণ্যপ্রীতি তৈরি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। তারা ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে পণ্য ব্যবহার ও সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছেন। আর এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মনে ভোগ্যপণ্যের প্রতি কৃত্রিম আকাঙ্ক্ষা তৈরি করা হচ্ছে। এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তির প্রয়োজনের কারণে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক চাপ।

ভোগবাদের একটি নেতিবাচক প্রভাব হলো এটি মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। ভোগবাদিতার মানে হলো, পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই ভোগের জন্য। যা ভোগের যোগ্য নয় তার কোনো মূল্য নেই। ভোগবাদীর কাছে ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় সম্পর্কও ভোগের বস্তু। যে সম্পর্কে ভোগের কিছু নেই তা টিকিয়ে রাখাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না ভোগবাদীরা। ভোগবাদিতায় ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যন্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রিত গৃহীত হয় ভোগের সুযোগ থাকা-না থাকার ভিত্তিতে।
ভোগ বস্তু-নির্ভর হওয়ার কারণে এখান থেকে যে সুখ আসে তা হয় ক্ষণস্থায়ী। ভোগবাদ মানবজাতিকে আত্মবিধ্বংসী পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভোগবাদী সমাজ প্রতিটি ক্ষণে আমাদের মনে এক শূন্যতা তৈরি করে যায়। সব সময় মনে হতে থাকে ‘আমার যা আছে তা যথেষ্ট নয়, আমার আরও চাই, যা আছে তা সর্বোত্তম নয়’। টাকা আছে কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। গাড়ী-বাড়ি আছে কিন্তু যথেষ্ট নয়। সময় আছে কিন্তু সে সময়ও যথেষ্ট নয়।
ভোগ ও ত্যাগ দু'টি বিপরীত জীবন-দর্শন। ভোগের দর্শন সেখানে ত্যাগকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ত্যাগের মধ্যেও যে সুখ আছে তা ভোগবাদীরা বুঝতে পারে না। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/আশরাফুর রহমান/১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।