আসমাউল হুসনা (পর্ব-৬)
গত কয়েক পর্বে মহান আল্লাহর কয়েকটি বিখ্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ নাম তথা আল্লাহ, রাহমান, রাহিম, রাব্ বা রব ও মালিক -এর নানা অর্থ, সংশ্লিষ্ট নানা দিক ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা শুনেছি আমরা। আজ আমরা মহান আল্লাহর কুদ্দুস নাম-এর সামগ্রিক নানা দিক ও তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আরবি কুদ্দুস শব্দটির অর্থ সব ত্রুটি থেকে মুক্ত বা পবিত্র। পবিত্র কুরআনে এ নাম দুই বার এসেছে। মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে যে মহান আল্লাহ মুক্ত সে বিষয়ও তুলে ধরা হয় এই নামের মাধ্যমে।
আরবি ভাষায় কুদ্দুস শব্দটি আধিক্যজ্ঞাপক শব্দগুলোর অন্যতম। এ ধরনের শব্দের মাধ্যমে ইতিবাচক বা নেতিবাচক গুণের ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়। মহান আল্লাহর কুদ্দুস নামের অর্থ পবিত্র, ত্রুটিহীন, অপূর্ণতা, দুর্বলতা বা ক্ষতি বা বিপদ থেকে মুক্ত থাকা ইত্যাদি। যেমন, মহান আল্লাহ শরিক থাকা, সন্তান বা স্ত্রী থাকার মত অপূর্ণতা বা দুর্বলতা, সৃষ্ট হওয়া ও নির্ভরশীল হওয়া এবং অর্থহীন ও অশোভনীয় সব কাজ করার মত দোষ-ত্রুটিসহ সব ধরনের বিপদ-আপদ ও ত্রুটি থেকে মুক্ত।
পবিত্র কুরআনের সুরা হাশরের ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ'র পরিচয় প্রসঙ্গে কুদ্দুস নামটি এসেছে: তিনিই আল্লাহ তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র বা ত্রুটিহীন.....। এ ছাড়াও সুরা জুমআ'র প্রথম আয়াতে আল্লাহর মহান এ নামটি এসেছে এভাবে:
রাজ্যাধিপতি, পবিত্র, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা বা গৌরব-মহিমা ঘোষণা করে, যা কিছু আছে নভোমন্ডলে ও যা কিছু আছে ভূমণ্ডলে।
পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাকারীরা কুদ্দুস বলতে বাহ্যিক ও অদৃশ্য সব অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকাকে বোঝান। পবিত্র ত্বুবা নামক স্থানে হযরত মুসা (আ)-কে পায়ের জুতা খুলতে বলেছেন মহান আল্লাহ। (সুরা নাজিয়াতের ১৬ ও সুরা ত্বাহার১২ নম্বর আয়াত) কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জুতার তলায় বাহ্যিক অপবিত্রতা লেগে থাকে। বাহ্যিক অপবিত্রতা ছাড়াও মহান আল্লাহ শির্ক ও সদৃশ কিছু থাকার মত অপবিত্রতাগুলো থেকেও মুক্ত।

সুরা হাশর ও জুমআ'য় কুদ্দুস শব্দটি এসেছে মালিক শব্দের পর। এর কারণ প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন: মালিক বা পরাক্রমশালী অধিপতি বা বাদশাহ বলতে অনেকেই এমন শক্তিশালী ব্যক্তিকে কল্পনা করে যে ব্যক্তি মাঝে মধ্যে জুলুম ও শোষণ করে থাকেন।
সুরা নাম্লে বলা হয়েছে: বাদশাহরা যখন কোনো শহর বা জনপদে প্রবেশ করেন তখন তা ধ্বংস করেন এবং সেখানকার সম্মানিত ব্যক্তিদের অপমান করেন। (৩৪ নম্বর আয়াত)। তাই কুরআনে মহান আল্লাহর মালিক নামের পরই কুদ্দুস নামটি এনে বোঝানো হচ্ছে যে এই মালিক দুনিয়ার মালিকদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও সব ত্রুটি থেকে মুক্ত বা পবিত্র।
মহান আল্লাহর নীতির রঙে রঙিন হতে হলে আমাদেরকে আল্লাহ'র গুণগুলো জানার পাশাপাশি সেসবের চর্চার সাধনা করতে হবে যার ওপর কুরআন ও হাদিসে ব্যাপক জোর দেয়া হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ'র গুণ হল মানুষের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখা। এ জন্য আল্লাহকে বলা হয় সাত্তার বা সাত্তারুল উইয়ুব! তাই আমাদেরও এ গুণের চর্চা করা উচিত। কাউকে কলঙ্কিত করা ও বন্ধুদের এবং অন্যদের গোপনীয় বিষয়গুলো প্রকাশ করে দেয়া উচিত নয়। মহান আল্লাহর কুদ্দুস নাম প্রসঙ্গেও আমাদের করণীয় কর্তব্য বা যা করা উচিত তা হল মহান আল্লাহর গুণগুলোর রঙে রঙিন হয়ে নিজেদের পবিত্র রাখা এবং আমাদের আচার-আচরণকে পবিত্র কুরআনের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা। আর কেবল তাহলেই আমরা খোদায়ি প্রজ্ঞা বা হিকমাত, অনুগ্রহ ও বরকত-এর সাগরে অবগাহন করতে সক্ষম হব।
হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ বলছেন: আকাশ ও জমিন আমাকে ধারণ করতে অক্ষম। কিন্তু আমার বান্দার অন্তরের বা হৃদয়ের এই ক্ষমতা রয়েছে। ইমাম জাফর আস সাদিক (আ) বলেছেন, মু'মিন ব্যক্তির হৃদয় হচ্ছে আল্লাহর ঘর ও স্থান। তাই এখানে অন্য কাউকে স্থান দিও না।
আমাদের হৃদয় আল্লাহর পবিত্র ঘর হওয়ায় এখানে লোভ-লালসা, প্রতিহিংসা, ইন্দ্রিয় দুর্বলতা, দুনিয়ার নানা আকর্ষণ ও শয়তানের কুমন্ত্রণাকে স্থান দেয়া উচিত নয়।
আমাদের হৃদয় যদি নোংরা বা অন্ধকার হয়ে যায় তাহলে সেখানে খোদায়ি জ্ঞান ও আলো প্রবেশ করতে পারে না। মহান আল্লাহর কুদ্দুস নামের রঙে রঙিন হতে হলে হৃদয়ের আয়নাকে পাপের কালিমা থেকে মুক্ত করতে হবে এবং কুপ্রবৃত্তিপনার আবর্জনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আর তাহলেই সেখানে মহান আল্লাহর নুর প্রবেশ করবে। পবিত্র কুরআনের সঙ্গে সব সময় সংযোগ রক্ষা করা ও খোদাভীরু ও সৎ আলেমদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, আত্ম-গঠন ও আত্মিক-পরিশুদ্ধি, পাপ বর্জন ও বিশেষ করে হারাম খাদ্য বর্জন এবং আল্লাহকে স্মরণ করা মানুষের অন্তরকে স্বচ্ছ ও পবিত্র করে।
মহান আল্লাহর স্মরণ হযরত ইব্রাহিম (আ)'র কাছে এত প্রিয় ছিল যে একবার তিনি শুনলেন যে কেউ বলছেন: সুব্বুহুন কুদ্দুস রাব্বানা ওয়া রাব্বিল মালায়িকাতি ওয়াররুহ। অর্থাৎ তিনি সবচেয়ে গৌরবময় ও পবিত্র আর তিনি হলেন ফেরেশতাদের ও জিবরাইলের প্রতিপালক! এ ডাকে এতোই মুগ্ধ ও পুলক অনুভব করলেন হযরত ইব্রাহিম যে তিনি তখনই প্রস্তাব ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, কে তুমি এমন সুন্দরভাবে আমার প্রিয়তম রাব্কে ডাকলে?!! আর একবার যদি আমার প্রিয়তমকে এমন সুন্দরভাবে ডাকো তাহলে আমি আমার বিপুল সংখ্যক ভেড়ার সবগুলোর মোট এক তৃতীয়াংশ দিয়ে দিব তোমাকে! এরপর আবারও শুনলেন সেই মধুর ডাক! ইব্রাহিম এবার বললেন: আর একবার যদি এই একই মিষ্টি ডাক শোনাও তাহলে দিয়ে দিবে বাদবাকি সব ভেড়া! পুনরাবৃত্তি হল সেই একই মধুর ডাকের! ইব্রাহিম নবী আত্মহারা হয়ে বললেন, আর একবার যদি বলো এই মধুর বাক্য তাহলে আমি তোমার ভেড়াগুলোর রাখাল হব।
হযরত ইব্রাহিম আরও একবার শুনলেন সেই সুমধুর সম্ভাষণ! এবার এ মহান নবী বললেন, আর তো কিছু নেই আমার তবুও আরো একবার যদি বলো এই নাম তাহলে আমি তোমার দাস হয়ে যাব! আবারও খোদা-প্রেমিক এই নবীকে শোনানো হল সেই প্রিয় বাক্য! এবার তিনি বললেন, আমার ও তোমার সব সম্পদ এবং আমার পুরো প্রাণ আমার প্রিয়তমের নামের জন্য কুরবানি করব!
উল্লেখ্য হযরত জিব্রাইল ফেরেশতা বলছিলেন সুব্বুহুন কুদ্দুস আর মিকাইল বলছিলেন রাব্বানা ওয়া রাব্বিল মালায়িকাতি ওয়াররুহ- একটি পাহাড়ের দুই প্রান্ত থেকে যার কাছে অবস্থান করছিলেন হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ। খলিলুল্লাহ শব্দের অর্থ আল্লাহর আন্তরিক বন্ধু! এ দুই মহান ফেরেশতা বলছিলেন! হে ইব্রাহিম আমরাই এতক্ষণ তোমার প্রিয়তমের নাম ধরে ডাকলাম! আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি মহান আল্লাহর ভালবাসা পাওয়ার উপযুক্ত। ইব্রাহিম নবীর ভেড়ার সংখ্যা ছিল এত বেশি যে ৪০০ কুকুর সেসব প্রহরা দিত।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।