নভেম্বর ১১, ২০২০ ২০:৩০ Asia/Dhaka

আমরা আগেই বলেছি, আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকা মুক্ত করার ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে ১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযান চালানো হয়।

এর মাধ্যমে ইরানের বন্দরনগরী খোররামশাহর শত্রুর দখলমুক্ত হয় এবং সার্বিকভাবে দেশের দখল হয়ে যাওয়া বেশিরভাগ এলাকা ইরান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরাকি বাহিনীর ইরান আগ্রাসন থেকে শুরু করে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আবাদান মুক্ত করা পর্যন্ত সময়ে ইরাকি বাহিনী ছিল আগ্রাসী ভূমিকায়। এই সময়টিতে ইরানকে অনেকটা আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে হয়েছে।  সে সময় ইরানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সেনাবাহিনীর দুর্বলতার কারণে আগ্রাসী সেনাদের হাত থেকে দখলীকৃত এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না।  ইরানের এই কোণঠাসা অবস্থা দেখে  দেশের ভেতরে ও বাইরে ইসলামি শাসনব্যবস্থার শত্রুরা মনে করেছিল, তেহরান হয়তো এবার ইরাককে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া শান্তি প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হবে।

মার্কিন মদদে ইরাকের ইরান আক্রমণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইরানের সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা অথবা যতটা সম্ভব দুর্বল করে ফেলা।  এ লক্ষ্যে ইরাকের সামরিক আগ্রাসনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তেহরানের ওপর ব্যাপক রাজনৈতিক চাপও সৃষ্টি করা হয়। ইরানের নব্য ইসলামি সরকার এতটা চাপের মধ্যে পড়ে যায় যে, ইরাক এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বাগদাদের পৃষ্ঠপোষকরা ইরানকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আশাবাদী হয়ে ওঠে।

কিন্তু এক বছরের মাথায় ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী যোদ্ধারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেন এবং তারা আবাদান শহরকে ইরাকি বাহিনীর অবরোধ মুক্ত করতে সক্ষম হন। ইরানের সামরিক শক্তির ব্যাপারে পশ্চিমা সমরবিদদের টনক নড়ে। পরবর্তীতে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের মাধ্যমে খোররামশাহরসহ প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন ইরানি যোদ্ধারা। এই বিজয়ের ফলে পারস্য উপসাগর ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। ফলে ইরাক-ইরান যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে যায়। এই বিজয়ের আগে ইরাকি বাহিনীর অকস্যাৎ আক্রমণের সামনে ইরানের সেনাবাহিনী আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকার কারণে দেশের একটি বিশাল এলাকা শত্রুসেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

ওই অবস্থায় ইরানের একদিকে যেমন দখল হয়ে যাওয়া অঞ্চল পুনরুদ্ধারের শক্তি ছিল না অন্যদিকে তেমনি চাপিয়ে দেয়া শান্তি প্রস্তাবকে তেহরান নিজের স্বার্থের বিপরীতে দেখতে পাচ্ছিল। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকায় আগ্রাসী ইরাকি সেনাদের দীর্ঘ উপস্থিতিও ইরানের জন্য সুখকর বিষয় ছিল না। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ইরানের পাল্টা হামলায় ইরাকি বাহিনীর দিশেহারা অবস্থা কোনোভাবেই বাগদাদের জন্য কাম্য ছিল না। পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ইরাকের পৃষ্ঠপোষকরাও ধারনা করতে পারেনি যে, যুদ্ধের মোড় হঠাৎ করে এমনিভাবে তেহরানের পক্ষে ঘুরে যাবে। ইরানের এই ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়টিকে পারস্য উপসাগর তথা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। আমেরিকা ও তার মিত্ররা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের তাবেদার আরব শাসকরা এতদিন বাগদাদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছিল। কাজেই  তারা তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজির এমন দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

বিশ্বের তৎকালীন সেরা রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানে ইরানের বিজয়কে ইরান-ইরাক যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ বলে অভিহিত করেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত গার্ডিয়ান ও প্যারিস থেকে প্রকাশিত লা মন্ড পত্রিকা আলাদা আলাদা বিশ্লেষণে একই সারমর্ম তুলে ধরে; আর তা হলো “খোররামশাহর সংঘর্ষ ইরান-ইরাক যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে। ” ফিনান্সিয়াল টাইমস এক নিবন্ধে জানায়: “খোররামশাহর সংঘর্ষে বিজয় মানে গোটা যুদ্ধ বিজয়। ” সে সময় বাগদাদে দায়িত্ব পালনরত একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন: “খোররামশাহর চলমান যুদ্ধের একটি উপাদান। ইরানিরা যদি এটি পুনরুদ্ধার করে তাহলে ইরাকিরা আর কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না।”

মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোশিয়েডেট প্রেস বা এপি খোররামশাহরের পতনকে তখন পর্যন্ত ২০ মাসের যুদ্ধে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের জন্য অবমাননাকর পরাজয় বলে অভিহিত করে। বিবিসি রেডিও সমরবিদদের উদ্ধৃতি দিয়ে খোররামশাহরের বিজয়কে ইরানের জন্য ‘সবচেয়ে বড় বিজয়’ বলে মন্তব্য করে।  অন্যান্য গণমাধ্যমে খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের ঘটনাকে যেসব শিরোনামে তুলে ধরা হয় সেগুলোর কয়েকটি হচ্ছে: “ইরাকি বাহিনীর অবমাননা”, “ইরাকিদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাশক্তির বড় পরাজয়”, “ইরাকের তেল অধ্যুষিত এলাকাগুলো এখন ইরানি যোদ্ধাদের দৃষ্টিসীমায়”, “ইরানি সৈন্যদের ইরাকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার সক্ষমতা অর্জন” ইত্যাদি।

খোররামশাহর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ফলে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সাদ্দামের পতন ঠেকাতে তার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্ররা ব্যাপক চেষ্টা-তদবির শুরু করে। আমেরিকা এ ব্যাপারে পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে বিশেষ করে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সতর্ক করে দেয়। এসব ক্রীড়নক আরব শাসককে ওয়াশিংটন জানিয়ে দেয়, ইরাকের বিরুদ্ধে ইরানের বিজয় মার্কিন স্বার্থের পরিপন্থি; কাজেই তেহরান যাতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে না পারে সেজন্য ওয়াশিংটন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এই সতর্কবার্তার মাধ্যমে আমেরিকা মূলত পারস্য উপসাগর তীরবর্তী আরব শাসকদেরকে ইরানের ভয় থেকে খানিকটা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে।

ইরানি যোদ্ধারা খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার কয়েকদিন পর ১৯৮২ সালের মে মাসে আমেরিকা প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে ইরাকের কাছে ছয়টি সামরিক পরিবহন বিমান বিক্রি করে। অথচ সে সময় আমেরিকার দৃষ্টিতে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক দেশ হিসেবে ইরাকের কাছে এ ধরনের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি নিষিদ্ধ ছিল। খোররামশাহর মুক্ত হওয়ার পর আমেরিকা ইরান-ইরান যুদ্ধের ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করে তা এই যুদ্ধ শেষে ফাঁস হয়ে যায়। ইরাকের তৎকালীন স্বৈরশাসক সাদ্দামের জামাতা হোসেইন কামিল ১৯৯৬ সালে দেশ থেকে পালিয়ে জর্দানে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়ার পর লেবাননের আস-সাফির পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সম্পর্কে বলেন: সাদ্দাম সে সময় চরম অস্থিরতায় ভুগছিল এবং ঘুমের ওষুধ না খেলে তার ঘুম আসত না। এরকম পরিস্থিতিতে  উইলিয়াম জনসন নামের একজন মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি ইরাক সফরে গিয়ে সাদ্দামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

তিনি সাদ্দামকে বলেন, যদি আপনি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেন তাহলে যুদ্ধ শেষে আমরা আপনাকে উপহার হিসেবে কুয়েতকে দিয়ে দেব। হোসেইন কামিল জানান, আমেরিকার এ প্রতিশ্রুতি শুনে সাদ্দাম যারপরনাই খুশি হয় এবং তার অস্থির চিত্ত শান্ত হয়। সে বলতে থাকে, কুয়েতকে পাওয়ার জন্য সে প্রয়োজনে ইরাকের সব সেনাকে বিসর্জন দেবে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।