পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-১২)
আশাকরি সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা নিয়ে খানিকটা কথা বলেছি। আমরা বলেছি পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি।
বেলজিয়ামে ৭১ শতাংশ বিয়েই শেষ পর্যন্ত তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদে গড়ায়। এদিক থেকে বেলজিয়াম গোটা বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। এরপরেই রয়েছে আরেক ইউরোপীয় দেশ পর্তুগাল। সেখানে তালাকের হার ৬৮ শতাংশ। এরপরে যথাক্রমে রয়েছে হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্পেন, লুক্সেমবুর্গ, স্তোনিয়া, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্রিটেনেও প্রায় অর্ধেক বিয়ে তালাকে গড়ায়। ২০১৯ সালের প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটেনের ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস রাজ্যে ৪২ শতাংশ দম্পতি বিয়ে টিকিয়ে রাখেননি, তারা তালাক নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সেখানে ৫০ শতাংশের বেশি বিয়ে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদে গড়ায়।

সারা বিশ্বেই নানা কারণে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। তবে সাধারণত যেসব কারণে ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে কয়েকটি হলো- আর্থ-সামাজিক সমস্যা, মানসিক রোগ, ক্রোধ, হতাশা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, আকাশচুম্বী প্রত্যাশা, বিশ্বাসঘাতকতা এবং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অদূরদর্শী ভূমিকা। এছাড়া একটি দেশ ও সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতিও একটি দম্পতিকে তালাকে উৎসাহিত করতে পারে। যেমন অনেক মুসলিম দেশেই তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদকে নিন্দনীয় বলে গণ্য করা হয়, এ কাজে অনুৎসাহিত করা হয়। এ কারণে ওই সব মুসলিম দেশে তালাকের হার তুলনামূলক কম। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বিশেষ করে অমুসলিম দেশগুলোতে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। যেকোনে ঠুনকো অজুহাতেই তারা আলাদা জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এ কারণে ওই সব দেশে তালাকের হার বেশি এবং ক্রমে তা বাড়ছে।
বর্তমানে পাশ্চাত্য-সমাজে যেকোনো উপায়ে আনন্দ উপভোগকে সবকিছুর চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়। ভোগের নীতির ভিত্তিতে এসব দেশের আইনকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে নারী ও পুরুষ স্বাধীনভাবে তাদের সব ধরণের ইচ্ছা-আকাঙ্খা মেটাতে পারে, চাইলেই পরনারী ও পরপুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। তাদের এই নীতি এবং দৃষ্টিভঙ্গিরই ফসল হচ্ছে আজকের ভোগবাদী প্রজন্ম। এই প্রজন্ম আগের যে কোন প্রজন্মের চেয়ে অনেক বেশি ভোগবাদী ও স্বার্থপর। তারা যেকোনো উপায়ে নিজের চাহিদা মেটানোর পক্ষপাতি। পাশ্চাত্যের সামাজিক সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন অনেকেই মনে করেন, সেখানে পরিবার প্রথা দুর্বল হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে সব কিছুর আগে নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার মানসিকতা। নিজের চাহিদা পুরণে ব্যাঘাত ঘটলেই তারা মনে করতে থাকেন পুরো জীবনটাই বৃথা। যেকরেই হোক জীবনকে ভোগ করতে হবে। অন্যের ক্ষতি করে হলেও নিজের চাহিদা পুরণ করতে হবে। এমন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষেরা একবারের জন্যও চিন্তা করেন না বিচ্ছেদের পর তাদের সন্তানদের কী হবে।

আসলে বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান শিকার হন সন্তানেরা। তারা বেড়ে ওঠে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান হিসেবে৷ যা তাদের স্বাভাবিক মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তারা এক ধরনের ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস' বা পরিচিতি সংকটে ভোগে। মনোচিকিত্সকরা মনে করেন, সন্তানরা যদি বাবা-মায়ের স্বাভাবিক সঙ্গ এবং ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। তারা সমাজকে, পরিবারকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখে। তাদের মধ্যে জীবনবিমুখতা তৈরি হয় যা ভয়াবহ। হতাশা ও বিষন্নতায় তারা বেড়ে ওঠে যারা একটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিবাহবিচ্ছেদ কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে উঠতেই পারে। এ কারণেই এ ধরণের একটি পন্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বামী বা স্ত্রী যখন কেবল তার নিজের স্বার্থের কথা ভেবে অন্যের জীবনকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয় তখন তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু পাশ্চাত্যে এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। প্রাচ্যের দেশগুলোতেও যে ঘটছে না তা বলা ঠিক হবে না। কিন্তু এই প্রবণতা পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজে অনেক বেশি।
বিশ্বখ্যাত বই সোশিওলজি বা সমাজবিজ্ঞানের লেখক এন্থনি গিডেন্স নিউজউইক ম্যাগাজিনের বরাত দিয়ে লিখেছেন, ১০ অথবা ২০ বছর ধরে সংসার করছেন এমন দম্পতির মধ্যেও বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে এর কারণ হলো নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার মনোবৃত্তি। জন্মনিরোধ ট্যাবলেট এবং ফেমিনিজমের যুগে নারীদের অনেকের মধ্যেই এ ধরনের ধারণার জন্ম হয়েছে যে, কামনা-বাসনা পরিবারের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মার্কিন নারীরা অতীতের চেয়ে অনেক বেশি ভোগবাদী। এ যুগের মেয়েরা তাদের দাদি-নানিদের চেয়ে অনেক বেশি অসহিষ্ণু। অবশ্য শুধু নারীদের মধ্যেই এ ধরনের প্রবণতা এ কথা বলাটা অত্যুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষরা কোনোভাবেই এর বাইরে নয়।
পাশ্চাত্যে পুরুষদের অনেকই পরিবার গঠন করেন শুধুমাত্র কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য। এ কারণে যখনই তার ব্যক্তি জীবন এবং ভোগের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় তখনই সে পরিবারকে দূরে ঠেলে দেয়, পরিবার তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। মানব জাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও একটি সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা প্রয়োজন তা তারা উপলব্ধি করতে পারে না। মানুষকে যদি যেনতেনভাবে যেখানে সেখানে তার যৌন আকাঙ্ক্ষা পূরণের অনুমতি দেয়া হতো তাহলে পরিবার প্রথাই চালু হতো না এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতো না। কিন্তু অনেকেই এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে লাগামহীন ও অবাধ যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। বাস্তবতা হচ্ছে যেসব সমাজে যৌন সম্পর্ক উন্মুক্ত এবং লাগামহীন সেখানেই পরিবার ব্যবস্থা দুর্বল। কারণ এ ধরনের সমাজের নারী ও পুরুষেরা যৌন সম্পর্কের জন্য পরিবার গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন না, তারা পরিবার বা বিয়ে বহির্ভূত যৌন সম্পর্কে জড়াতে দ্বিধাবোধ করেন না। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।