'ইরানকে দমিয়ে রেখে ইসরাইলকে রক্ষা করাই পাশ্চাত্যের মূল মিশন'
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বড় অর্জন হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ইরানকে মুক্ত করে প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করা। ধর্মভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা। ইরানের ইসলামী ব্প্লিবের ৪২ তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ইরান প্রবাসী বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক আবুল কাসেম মো. আনোয়ার কবির।
তিনি বলেন, পাশ্চাত্যের মূল মিশন হচ্ছে ইরানকে দমিয়ে রাখা এবং ইসরাইলকে রক্ষা করা।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব আনোয়ার কবির, আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ৪২তম বিজয় বার্ষিকী উদযাপিত হতে যাচ্ছে। এই যে বিপ্লব সফল হয়েছে- এর প্রধান অর্জনগুলো কী?
আনোয়ার কবির: আপনাকে ধন্যবাদ। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ৪২তম বিজয় বার্ষিকী পালিত হতে যাচ্ছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে আমার দৃষ্টিতে যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে সেগুলো হচ্ছে-
সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ইরান মুক্তি লাভ করেছে। না প্রাচ্য না পাশ্চ্যাত্য- এই দুই নীতির বিরুদ্ধে অটল থেকে পরাশক্তিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রকৃত যে স্বাধীনতা সেটা অর্জন করেছে ইরান।
দ্বিতীয় অর্জন-হচ্ছে - ইরানে একটি ধর্মভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পৃথিবীতে যখন কমিউনিজম এবং লিবারালিজম এই দুই ধারার বাইরে অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না- বরং দুটো ধারাই ধর্মহীন এক সেক্যুলার অবস্থা যেখানে ধর্ম একান্ত ব্যক্তিগত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল। সেই বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে ধর্মভিত্তিক গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি ইরানের দ্বিতীয় বড় অর্জন।
তৃতীয় অর্জন হচ্ছে- ইরানি জাতির মধ্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। কোনো পরাশক্তির সাহায্য ছাড়াই যে নিজের পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব এবং সুদীর্ঘ ৪২ বছর ধরে টিকে থাকা সম্ভব সেটি ইরানি জাতি আজ বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে।
আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমার কাছে যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের প্রকৃত শক্র ইসরাইল-সেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। আমরা দেখতে পাই- হামাস, ইসলামী জেহাদ, হিজবুল্লাহসহ অন্যান্য ইসরাইলবিরোধী যে গ্রুপগুলো রয়েছে তার সবগুলোই ইসলামী বিপ্লবের সফলতার ফল। ইসলামী বিপ্লব কেবল অভ্যন্তরীণভাবেই নয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
রেডিও তেহরান: আপনার কী মনে হয় ইসলামি বিপ্লব তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে?

আনোয়ার কবির: আমার দৃষ্টিতে অবশ্যই ইসলামী বিপ্লব তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিতেও আমরা বিষয়টি লক্ষ্য করছি। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পতন ঘটানোর জন্য – জিমি কার্টার থেকে শুরু করে রিগ্যান, জর্জ ডব্লিউ বুশ, জুনিয়র বুশ, ওবামা এবং ট্র্যাম্প সব র্মার্কিন প্রেসিডেন্ট গত ৪২ বছর ধরে ইরানের ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছেন এবং অব্যাহত রেখেছেন সেই চেষ্টা। জন বোল্টন গত বছর আশা করেছিলেন ইরানের নববর্ষে তিনি রাজধানী তেহরানে নতুন বছর উদযাপন করবেন। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে ইরানের ইসলামি সরকাগুলো।
এরফলে ইসলামের শক্ররা ভালোমতো বুঝতে পেরেছে যে ইরান তার প্রকৃত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যতই দিন যাচ্ছে ততই ইরানের ইসলামী বিপ্লব আরও শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সুতরাং আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি ইরান তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
রেডিও তেহরান: ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। বিপ্লবের ৪২ বছর পরে এসে ইরানের সে অবস্থানকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনোয়ার কবির: দেখুন, আমার কাছে যেটা মনে হয় সেটি হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধের ইরানের উদ্যোগুলো আরও সক্রিয় করেছে। দৃঢ়ভাবে তারা এ পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছি ফিলিস্তিনের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি সাহায্য অব্যাহত রেখেছে ইরান। ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ইসরাইলকে রক্ষা করার জন্য। তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ধরনের সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত করার উসকানি দিয়েছে। তাদের একটাই উদ্দেশ্য-সেটি হচ্ছে ইসরাইলকে রক্ষা করা। আর সেই চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সেই চেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইরান-তাদের উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। ইসলামী ইরান সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে তাল না মিলিয়ে তাদের স্বার্থকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে। আর সে কারণে তারা ইরানের জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা করেছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলো ইরানকে কেন্দ্র করে সাজিয়েছে। এতে মনে করা যায়- ইরানই হচ্ছে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ। এসব থেকে বলা যায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইরানকে ভয় পায় আর সে কারণেই তাদের কর্মকাণ্ড ইরানকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে ইরান তার সঠিক পথেই রয়েছে।
রেডিও তেহরান: মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইরান যে ভূমিকা পালন করছে তাতে অনেকে নাখোশ। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের এই ভূমিকা খর্ব করতে চায়। বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন আপনি?
আনোয়ার কবির: দেখুন, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থান শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয় রাজনৈতিকও। অর্থনৈতিক বিষয়টি হচ্ছে-সারা বিশ্বের তেল সম্পদের একটা বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। তারা এখানের তেল সম্পদের দ্বারা লাভবান হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমেরিকা ও ইউরোপের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইসরাইলকে রক্ষা করা যেকথা একটু আগেও বলেছি। আমেরিকা এবং ইউরোপের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইসরাইল। ফলে ইসরাইলকে কেন্দ্র করেই তাদের পলিসি নির্ধারণ করে। আমার কাছে মনে হয় পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ভূমিকাকে যে খর্ব করতে চায় তার কারণ- ইসরাইলকে রক্ষা করা এবং ইরানকে প্রতিহত করা। এটা করতে পারলে তারা সহজে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করতে পারবে। পৃথিবীর অন্যতম তেল সমৃদ্ধ একটি দেশ ইরান। তাই ইরানকেও তাদের কব্জায় নিতে চায়। যখন সেই কাজটি করতে সক্ষম হচ্ছে না পশ্চিমা দেশগুলো তখন তারা ইরানের ভূমিকাকে খর্ব করতে চায়।
রেডিও তেহরান: মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এখন বড় শক্তি হিসেবে চিহ্নিত। আপনার দৃষ্টিতে
আনোয়ার কবির: দেখুন, যদি ইসলামী বিপ্লব না হতো তাহলে ইরান এত বড় শক্তিতে পরিণত হতে পারত না। ইরানের শক্তির মূল উৎস ইসলামী বিপ্লব। একটা তুলনামূলক চিত্রে আমরা দেখতে পাই, ইসলামী বিপ্লবের আগে আমরা দেখেছি সবকিছুতে ইরান পরনির্ভর ছিল। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমন কোনো বিষয় ছিল না যে তারা পাশ্চাত্যের কাছ থেকে গ্রহণ করত না। কিন্তু ইরান ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী বলয় থেকে বেরিয়ে আসল এবং স্বনির্ভর একটা দেশ হিসেবে আর্বিভূত হল তখন সবদিক থেকেই ইরান এগিয়ে গেল।
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৮
- বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।