ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ‘বিস্ময়কর আক্রমণ’ কৌশল কেন ব্যর্থ হলো?
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i152658-ইরানের_বিরুদ্ধে_ইসরায়েলের_বিস্ময়কর_আক্রমণ’_কৌশল_কেন_ব্যর্থ_হলো
পার্সটুডে: ২০২৫ সালের ১৩ জুন ভোরে, ইসরায়েল নাৎসি জার্মানির ব্লিৎজক্রিগ বা ‘বিস্ময়কর আক্রমণ' কৌশল অনুকরণ করে একটি সমন্বিত ও আকস্মিক হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক কমান্ড ও অবকাঠামো এবং রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কাঠামো ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে গেল এবং আগ্রাসী ইসরায়েল এক ভিন্ন সত্যের মুখোমুখি হলো।
(last modified 2025-10-08T09:10:00+00:00 )
অক্টোবর ০৫, ২০২৫ ১৭:২৩ Asia/Dhaka
  • অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩
    অপারেশন ট্রু প্রমিজ-৩

পার্সটুডে: ২০২৫ সালের ১৩ জুন ভোরে, ইসরায়েল নাৎসি জার্মানির ব্লিৎজক্রিগ বা ‘বিস্ময়কর আক্রমণ' কৌশল অনুকরণ করে একটি সমন্বিত ও আকস্মিক হামলা চালিয়ে ইরানের সামরিক কমান্ড ও অবকাঠামো এবং রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কাঠামো ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে গেল এবং আগ্রাসী ইসরায়েল এক ভিন্ন সত্যের মুখোমুখি হলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে নাৎসি জার্মানি প্রথমে পোল্যান্ড এবং পরে ফ্রান্সে ‘বিস্ময়কর আক্রমণ কৌশল প্রয়োগ করেছিল। কৌশলটি তিনটি উপাদানের উপর নির্ভরশীল ছিলকমান্ড সেন্টার ও ঘাঁটির অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য, যোগাযোগ লাইন ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণ কেন্দ্রগুলোতে কেন্দ্রীভূত আঘাত এবং সৃষ্ট মানসিক আঘাতের সুযোগ নিতে দ্রুত সাঁজোয়া ইউনিটের অনুপ্রবেশ।

ফার্স নিউজ এজেন্সির উদ্ধৃতি নিয়ে পার্সটুডে জানায়, বিএইচ লিডেল হার্ট ও জন কিগানের মতো সামরিক বিশেষজ্ঞরা এই পদ্ধতিটিকে কার্যক্রমের গতি, বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয় এবং শত্রুর সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করার দিক থেকে বর্ণনা করেছেন। এই একই মডেলই ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনাকারীদের নির্দেশিকা ছিল।

যা হিটলারের বিখ্যাত ব্লিৎজক্রিগ বা বিস্ময়কর আক্রমণ কৌশলের সফল পুনরাবৃত্তি হওয়ার কথা ছিলঅর্থাৎ শত্রুর কমান্ডের কেন্দ্র এবং যোগাযোগ নেটওয়ার্কে দ্রুত, কেন্দ্রীভূত ও পঙ্গু করে দেওয়ার আঘাততা ১৩ জুন ভোরে ইরানের বিরুদ্ধে আরম্ভ হল। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত আত্মসমর্পণ বা ধ্বংসাত্মক সফলতা নিয়ে শেষ না হয়ে, আক্রমণকারী এক কৌশলগত ব্যর্থতার সম্মুখীন হয় এবং ইরান কৌশলগতভাবে প্রতিরোধ ও উদ্যোগ ফিরে পায়।

ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিলসেনা ও সর্বোচ্চ কমান্ডকে নিশানা করে, যোগাযোগ কেন্দ্রগুলোর উপর বোমা বর্ষণ ও শীর্ষ কমান্ডারদের বিরুদ্ধে টার্গেটেড অপারেশন চালিয়ে ইরানের কমান্ড-চেইনকে অকার্যকর করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।

প্রাথমিক পর্যায়ে বিস্তৃত ইলেকট্রনিক যুদ্ধ, ড্রোন আক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ গুপ্তচরদের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কঠিন অবস্থার মুখে ঠেলে দেয়। প্রথম দেখায় মনে হচ্ছিলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এবং নেতাদের অপসারণ ঘটলে কেন্দ্রীভূত প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়বে।

টার্নিং-পয়েন্ট: কাঠামোগত নমনীয়তা ও দ্রুত কমান্ডার প্রতিস্থাপন
শীর্ষ কমান্ডারদের ওপর আঘাত তখনই ব্যর্থ হয় যখন প্রতিপক্ষের হাতে অবিলম্বে বিকল্প কমান্ড ও সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ব্যবস্থা থাকে। ইরান পূর্ব-নকশাকৃত পরিকল্পনাগুলো কার্যকর করে দ্রুত নতুন কমান্ডার নিয়োগ ও পূর্ব-বিভক্ত যোগাযোগ চ্যানেল সক্রিয় করে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নেয়।  ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ির দ্রুত নির্দেশ ও নিয়োগ প্রক্রিয়া দেশটির সামরিক কাঠামোর গভীরতা ও নমনীয়তা প্রতিপাদন করেযা দ্রুত পতনকে রোধ করল।

কৌশল বদল: আক্রমণকে ব্যয়সাপেক্ষ যুদ্ধে রূপান্তর
ইরান সরাসরি সম্মুখীন লড়াই এড়িয়ে সস্তা ড্রোন, বিচ্ছিন্ন হামলা এবং টার্গেটেড ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধকে এমন এক ধরনে টেনে নিল যে, আক্রমণকারী ও তাদের মিত্রদের উপর প্রচুর প্রতিরক্ষা ও লজিস্টিক ব্যয় চাপিয়ে দিল। প্রতিটি হামলা প্রতিহত করার জন্য ইসরায়েল ও তার মিত্রদেকে বড় আর্থিক ও প্রযুক্তিগত খরচ বহন করতে হল। ফলে, দ্রুত নির্ধারণী বিজয়ের বদলে লড়াই একটি দীর্ঘায়িত ও খরচবহুল পর্যায়ে প্রবেশ করলযা রক্ষাকারীর পক্ষে ফলপ্রসূ হল।

অভেদ্য আয়রন ডোমের সীমাবদ্ধতা
বিভিন্ন প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ইরানের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনগুলো অনেক কৌশলগত লক্ষ্যে আঘাত করেছে; ফলে আক্রমণকারীর বহুস্তরীয় প্যাডফ্যান্স এবং তাদের সমর্থকদের দাবি করা সর্বাত্মক কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হলো। ময়দানে ধাপে ধাপে ইরান আবারও উদ্যোগ নিজের হাতে নিয়ে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাতে সক্ষম হয়, যা তাদের অপারেশনাল সক্ষমতা জটিল পরিস্থিতিতেও বজায় থাকার কথা নির্দেশ করে।

জাতীয় ঐক্য: ময়দানের গোপন শক্তি
ইরানে অভ্যন্তরীণ বিভেদ সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা করা হয়েছিল তা ব্যর্থ হলো; জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের প্রতিরোধের কারণে পঞ্চম স্তম্ভের চেষ্টা কাজে লাগল না। একই সঙ্গে বহিরাগত সহায়তাকারীদের উপর আর্থিক ও লজিস্টিক চাপ বৃদ্ধির ফলে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। ফলত, সামরিক সফলতার সঙ্গে-সঙ্গে আক্রমণকারীর রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থাও দুর্বল হলো।

নাৎসি জার্মানির ঐতিহাসিক কৌশল নকল করে দ্রুত ও সিদ্ধান্তমুখী ফল পাওয়ার চেষ্টা দুটি মূল কারণে ব্যর্থ হয়েছিলপ্রথমত, প্রতিরক্ষার কাঠামোগত গভীরতা ও সামরিক নমনীয়তা, যা দ্রুত কমান্ড প্রতিস্থাপন ও কার্যক্রম বজায় রাখতে সক্ষম করে; দ্বিতীয়ত, ইরানের অসম কৌশল আক্রমণকারীর জন্য লম্বা ও ব্যয়সাপেক্ষ সংঘাতে ধরা দিল যা সমর্থকদের জন্যও বহনযোগ্য ছিল না।

১২ দিনের যুদ্ধে ইরান পরাজিত হয়নি; ইসরায়েলের ব্লিৎজক্রিগ-শৈলীর আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে এবং ব্যবহারিকভাবে এটি ইরানকে ময়দানে বিজয়ী প্রমাণ করেছে।

এই রাজনৈতিক-সামরিক পাল্টা-মীমাংসার একটি স্পষ্ট বার্তা আছে। আর তা হলো- ইতিহাসের কৌশলগুলো পুনরায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ না করে কেবলই নকল করলে, বিশেষত যদি প্রতিপক্ষের কাঠামোগত গভীরতা, স্থিতিস্থাপকতা ও অসম কৌশলগত সক্ষমতাকে উপেক্ষা করা হয়, তখন তা কেবল সামরিক ব্যর্থতাই নয় বরং আক্রমণকারী ও তাদের সমর্থকদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ব্যয় ও ক্ষতির মুখোমুখি করতে পারে।#

পার্সটুডে/এমএআর/৫