ইরান কি ইহুদিদের ধ্বংস করতে চাইছে? ইসরাইলের জন্য ইরানের সমাধান কি?
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই সহিংসতা এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালানোর বিরোধী। মনে রাখা উচিত- ইরান কি ইহুদি ও ইহুদিবাদীদের ধ্বংস করতে চাইছে? বা ইসরাইলিদের জন্য ইরানের সমাধান কী এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু সহজ জিনিস জানা উচিত যাতে এই প্রশ্নটি তৈরি করা কোনো প্রপাগান্ডা বা মিথ্যা প্রচারণার নীচে আটকা পড়ে না যায়। পার্সটুডের আজকের নিবন্ধে এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয়া হয়েছে :
১. ইহুদি এবং ইহুদিবাদীদের মধ্যে পার্থক্য
হাজার বছরের শিকড় সহ একটি ধর্ম হিসাবে ইহুদি ধর্ম সবসময় ইরানীদের জাতীয় এবং ধর্মীয় চিন্তাধারায় সম্মানিত হয়ে আসছে। ইরান ইতিহাস জুড়ে যেমন সাইরাস দ্য গ্রেটের সময় থেকে যিনি ইহুদিদের ব্যাবিলনের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেছিলেন এখন পর্যন্ত ইহুদিদের আশ্রয়স্থল হিসেবে নিজের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে আসছে। ইরানের ইহুদি সম্প্রদায় এদেশে তাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলো পালন করে আসছেন এবং এমনকি ইরানের সংসদে তাদের প্রতিনিধিও রয়েছে। কিন্তু ইহুদিবাদ ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তিতে এবং একটি আধুনিক রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। ইহুদীবাদের বিরুদ্ধে ইরানের সমালোচনা ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার কারণে নয় বরং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া ও তাদের উপর বছরের পর বছর ধরে দমন পীড়নের কারণে। অবশ্যই ইরান যেহেতু ইহুদিদের ধ্বংস ও হত্যা করার চেষ্টা করে না এবং ইহুদিবাদের সাথে এটির কোনো সম্পর্ক নেই যতক্ষণ না এটির বিপজ্জনক চিন্তাভাবনা নিপীড়নের কারণ না হয়। তাই এটির বর্ণবাদী, নিপীড়নমুলক এবং শোষণবাদী চিন্তা সম্পর্কে বিশ্বকে অবহিত করা তার কর্তব্য বলে মনে করে।
২. এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর অংশ হিসাবে ইহুদিদের গ্রহণযোগ্যতা
ইরান বারবার বলে আসছে যে জাতি বা ধর্ম হিসেবে ইহুদিদের সঙ্গে তার কোনো সমস্যা নেই। প্রকৃতপক্ষে এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এই নীতির উপর ভিত্তি করে যে জাতি এবং ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ইরান ইহুদিদেরকে বিশ্ব ও অঞ্চলের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে শত্রু হিসেবে কখনই বিবেচনা করে না।
৩. ইরানের সমাধান: অভিবাসী ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন এবং ফিলিস্তিনি গণভোট
ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানের জন্য ইরানের মূল ধারণা দুটি যৌক্তিক এবং গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত, ভুয়া ইসরাইলি সরকারের বিলুপ্তি এবং ইউরোপ,আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশ থেকে ইহুদি অভিবাসীদের তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করা। ১৯১৭ সাল থেকে অধিকাংশ ইহুদি ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে অনুপ্রবেশ করেছে । এই প্রস্তাবটি এমন একটি নিয়মের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যা সমস্ত জাতির জন্য "প্রত্যাবর্তনের অধিকার" ধারণাকে সম্মান করে যেমন একজন ইহুদি ধর্মের জার্মানির জার্মানিতে প্রত্যাবর্তন এবং ইহুদি ধর্মের একজন হাঙ্গেরিয়ানকে তার নিজের দেশ হাঙ্গেরিতে প্রত্যাবর্তন করা। দ্বিতীয়ত ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দাদের অবাধ গণভোট অনুষ্ঠিত করা অর্থাৎ যারা দখলের আগে ফিলিস্তিনি ভূমিতে বসবাস করত এবং এখন হয় প্যালেস্টাইনে আছে বা ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে ইসরাইলিদের নিপীড়নের কারণে দেশান্তরিত হয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনা যাতে প্রকৃত ফিলিস্তিনি জনগণ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়। এই প্রস্তাব গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়বিচার উভয়ই।
৫.আন্তর্জাতিক আইন এবং বিশ্ব ন্যায়বিচারের উপর জোর দেওয়া
ইরান আন্তর্জাতিক আইন ও বৈশ্বিক ন্যায়বিচার মেনে চলে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের নীতিগুলো এমন নীতির উপর ভিত্তি করে তৈরি যা আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশনগুলিতেও জোর দেওয়া হয়েছে: যেমন তাদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য জাতির অধিকারের ওপর জোর দেয়া। এর অর্থ দখলের বিরোধিতা করা এবং অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া। ন্যায়বিচারের নীতির উপর জোর দিয়ে ইরান বিশ্বাস করে যে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিদের দুটি ঐতিহাসিক জাতি হিসাবে আন্তর্জাতিক আইন এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের কাঠামোর মধ্যে বসবাস করা উচিত।
৬. ঔপনিবেশিকতা প্রত্যাখ্যানের উপর জোর দেওয়া
ইরান এবং প্রতিরোধ সংগঠনগুলো ইসরাইলের সাথে লড়াই করছে কারণ ইহুদিবাদ একটি ঔপনিবেশিক প্রকল্প হিসাবে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল এবং ইসরাইল সৃষ্টির মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে আক্রমণ করেছে। এই আগ্রাসন শুধু ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও ভূমিরই ক্ষতি করেনি, বরং এটি ইসরাইলের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। তাদের দাবি অনুযায়ী, তাদের প্রভাব বিস্তার করে এই অঞ্চলের অন্যান্য ভূমি দখল করা। ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী নীতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি পশ্চিম এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে এবং এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে অপরিহার্য করে তুলেছে। অবশেষে ইরান, মানব-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অভিবাসী ইহুদিদের তাদের ভূমিতে প্রত্যাবর্তন এবং ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দাদের গণভোটের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সংকটের সমাধানে প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এটি এমন একটি সমাধান যা কেবল রাজনৈতিক স্তরেই নয় নৈতিক ও দার্শনিক স্তরেও এর গুরুত্ব রয়েছে যার মূলে রয়েছে ন্যায়বিচারের নীতি এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা। স্বাভাবিকভাবেই কেউ যদি কথা বলার এবং সভ্য মানবিক নিয়ম ব্যবহারের পরিবর্তে অস্ত্র এবং আগ্রাসন ব্যবহার করে তবে সে স্বাভাবিকভাবেই এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া পাবে।#
পার্সটুডে/এমবিএ/৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।