ইউক্রেনে রুশ অভিযানের ১০০০ দিন পূর্ণ
পশ্চিমা যুদ্ধবাজরা যে কৌশলে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের যুদ্ধ বাঁধাতে চায়
পার্সটুডে- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর এক হাজারতম দিন উপলক্ষে গত ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
পার্সটুডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের পর্যায়ক্রমিক সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড লেমি। তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল এই দেশটি বা ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয় নয় বরং এর সঙ্গে গোটা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা জড়িত।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর এক হাজারতম দিবস উপলক্ষে এমন সময় এ বৈঠকে অনুষ্ঠিত হলো যখন জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার ইউক্রেনকে পাশ্চাত্যের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার গভীর অভ্যন্তরে হামলা চালানোর অনুমতি দিয়েছে। এ কারণে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ পরিস্থিতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে খারাপের দিকে যেতে পারে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘোষিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১১ হাজার বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও ২৫ হাজার জন আহত হয়েছেন। অঘোষিত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে মনে করা হয়।
ইউক্রেনের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া ছাড়াও দেশটির প্রায় এক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৬৮ লাখ আশপাশের দেশগুলোতে পালিয়ে গেছেন। এ বিষয়গুলোকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রধান ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এছাড়া, ইউক্রেন এখন মাইন স্থাপনের দিক দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চলগুলোর অন্যতমতে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক ধারনা অনুযায়ী, ইউক্রেনকে পুনর্গঠন করার জন্য ৫০০ বিলিয়ন ডলার অর্থের প্রয়োজন হবে, আর এ কাজ শেষ করতে লাগবে অন্তত ১০ বছর।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের দুই পক্ষ অর্থাৎ রাশিয়া ও ইউক্রেন পরস্পরের বিপুল সংখ্যক সেনাকে হত্যা করার পাশাপাশি অস্ত্রসস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামেরও বড় ধরনের ক্ষতি করার দাবি করেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকৃতিগত পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়। তিনি ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। ট্রাম্প আগেই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ক্ষমতায় ফিরতে পারলে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যবস্থা নেবেন। এর ফলে ইউক্রেনের সমর্থক ইউরোপীয় দেশগুলো বিশেষ করে জার্মানি একথা বুঝে গেছে যে, ইউক্রেন যুদ্ধকে আর আগের মতো করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনি প্রচারে ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে ইউক্রেনকে আমেরিকার পক্ষ থেকে দেয়া হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন ট্রাম্প। এছাড়া, ন্যাটো জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন আমেরিকার সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। এ কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মারাত্মক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ইউক্রেনকে দেয়া মার্কিন সহায়তার পরিমাণ নিয়ে যেমন ট্রাম্প ত্যক্ত-বিরক্ত, তেমনি তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বড় বিক্রেতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মাত্র দুই মাস পর আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাওয়া ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি যখন এই, তখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে এক নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে পরামর্শ করে ইউক্রেনকে পাশ্চাত্যের দেয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার গভীর অভ্যন্তরে হামলা চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। ইউক্রেনকে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে তার একটির পাল্লা ৩০০ কিলোমিটার এবং আরেকটির পাল্লা ৫০০ কিলোমিটার। বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে ভয়াবহ বিপজ্জনক বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
ওয়াশিংটনের এ সিদ্ধান্তকে ইউক্রেন স্বাগত জানালেও রাশিয়া এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।
এখানে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, যে ইউরোপীয় দেশগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরবর্তী মেয়াদে ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত, সেই ইউরোপীয় দেশগুলো বাইডেন প্রশাসনের নতুন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরন ইউক্রেনকে রাশিয়ার গভীর অভ্যন্তরে হামলা চালানোর মার্কিন অনুমতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ইউরোপীয় নেতারা এখন একথা ভাবছেন যে, বাইডেন প্রশাসনের নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেলে আমেরিকা ইউক্রেন যুদ্ধে এত বেশি জড়িয়ে পড়বে যে, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইলেও আর এ যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন না। হয়তা বাইডেন প্রশাসনও এ ধরনের কিছু চিন্তা করেই নিজের অন্তিম মুহূর্তে এমন একটি অনুমতি ইউক্রেনকে দিয়েছে।
যাই হোক, ওয়াশিংটনের নতুন সিদ্ধান্তকে স্বাভাবিকভাবেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। মস্কো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এর ফলে ইউক্রেন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে এমনকি এটি ভূপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবার জোরেসোরে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করারও হুমকি দিয়েছেন। এ অবস্থায় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস পরিস্থিতির আরো বেশি অবনতি রোধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এরপরও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পাশ্চাত্যের সহযোগিতা নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যে প্রত্যয় দেখাচ্ছেন তার ফলে কেবল তার দেশেরই জানমালের আরো বেশি ক্ষতি হবে। জেলেনস্কিকে একথা বুঝতে হবে যে, আমেরিকা হোক কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলো, তারা দূরে বসে সিদ্ধান্ত নিলেও যুদ্ধক্ষেত্রে নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছে ইউক্রেনের জনগণ ও সেনাবাহিনী। কাজেই পশ্চিমা দেশগুলো যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন তার খেসারত ইউক্রেনবাসীকেই দিতে হবে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।