কোপেনহেগেন বৈঠক ইসরায়েল ইস্যুতে ইউরোপের মতবিরোধ লোক দেখানো নয় কী?
-
• কোপেনহেগেনে ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক
পার্সটুডে- কোপেনহেগেনে ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ইসরায়েলের ব্যাপারে ইউরোপের মতবিরোধের একটি প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে।
পার্সটুডে অনুসারে, শনিবার ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ইসরায়েলের উপর কীভাবে চাপ প্রয়োগ করা যায় তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা, কিন্তু বৈঠকটি তাদের লোক দেখানো মতবিরোধের একটি প্রদর্শনীতে পরিণত হয়।
গাজা যুদ্ধের জন্য ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে ইসরায়েলি স্টার্ট-আপগুলোর জন্য অর্থায়ন স্থগিত করার একটি প্রস্তাব নিয়েও তাদের আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। অবশ্য, ইইউ পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে একটি নথি অনুমোদন করেছেন যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিদলের ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য বলা হয়।
বৈঠকের পর ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাইয়া কালাস বলেন, গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইইউ সদস্যরা দ্বিধাগ্রস্তই রয়ে গেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে এই মতবিরোধ ইইউর আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, “এটা স্পষ্ট যে সদস্য দেশগুলি ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতি পরিবর্তন করার বিষয়ে একমত নয়। বিকল্পগুলি স্পষ্ট এবং এখনও টেবিলে রয়েছে। আমরা বিকল্পগুলি উপস্থাপন করেছি। কিন্তু সমস্যা হল যে সমস্ত ইইউ সদস্য দেশ এর সাথে একমত নয়” ।
ইইউর শীর্ষ কূটনীতিক বলেন, ইসরায়েলের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্থগিত করার প্রস্তাবে সদস্য দেশগুলি এখনও একটি চুক্তিতে পৌঁছায়নি। জার্মানি এবং হাঙ্গেরিসহ কিছু দেশ এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে ডেনমার্ক, যা বর্তমানে ইইউর সভাপতিত্ব করছে, ইসরায়েলের সাথে বাণিজ্য স্থগিতের পক্ষে সমর্থন করে।
সাম্প্রতিক মাসগুলিতে, ইউরোপ জুড়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা আশা করছে তাদের সরকারগুলি যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেবে; এটি এমন একটি যুদ্ধ যা বিশেষজ্ঞরা গণহত্যা হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
গত মাসে ইউরোপীয় কমিশন ইইউর গবেষণা তহবিল কর্মসূচিতে ইসরায়েলের প্রবেশাধিকার সীমিত করার প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু এই পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ইইউ সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং আয়ারল্যান্ডের মতো কিছু দেশ এখনও পর্যন্ত এই পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে, অন্যদিকে জার্মানি এবং ইতালির মতো অন্যরা এখনও এটিকে সমর্থন করেনি।
ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়া বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে মতবিরোধ বহুমুখী সমস্যা তৈরি করেছে। এই মতবিরোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এবং দিকগুলির মধ্যে রয়েছে:
১. ফিলিস্তিন ইস্যুতে মতভিন্নতা
কিছু ইউরোপীয় দেশ, বিশেষ করে যাদের বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি বা মানবাধিকারের প্রতি শক্তিশালী সমর্থন রয়েছে (যেমন স্পেন, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড বা বেলজিয়াম), তারা ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের নীতির সমালোচনা করে এবং তাদের শাস্তি বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায়। অন্যদিকে অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে যাদের ইসরায়েলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বা সংকটের বিষয়ে আরও মধ্যপন্থী অবস্থান রয়েছে (যেমন জার্মানি, ফ্রান্স বা হাঙ্গেরি), তারা নিষেধাজ্ঞা বা কঠোর শাস্তি এড়াতে পছন্দ করে এবং কূটনৈতিক সমাধান এবং আলোচনার উপর বেশি জোর দিচ্ছে।
২. কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব
ইসরায়েল অনেক ইউরোপীয় দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত অংশীদার এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ইউরোপীয় দেশগুলি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক বজায় রেখে ইসরায়েলি নীতিগুলিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। অবশ্য, এটি এখন পর্যন্ত কঠিন বা অসম্ভব প্রমাণিত হয়েছে।
৩. ঐতিহাসিক মনোভাব এবং নিরাপত্তা সংবেদনশীলতা
কিছু ইউরোপীয় দেশ, বিশেষ করে জার্মানি, ইহুদি ও ইসরায়েলের সাথে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আরও সতর্ক অবস্থান নিয়েছে, তাদের দাবি এতে করে ইহুদি-বিরোধী মনোভাবকে উস্কে হবে। যদিও ইহুদি ধর্ম এবং ইহুদিবাদের একে অপরের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই।
৪. ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভূমিকা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধারণত দাবি করে যে তারা আলোচনার মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। কিছু ইইউ সদস্য রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বা নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করতে পছন্দ করে।
৫. জনমত এবং চাপ গোষ্ঠীর প্রভাব
কিছু দেশে, জনমত, মানবাধিকার এবং ফিলিস্তিনি কর্মী গোষ্ঠীগুলি সরকারগুলিকে কঠোর অবস্থান গ্রহণের জন্য চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অভিবাসী জনসংখ্যা বা ফিলিস্তিনের সমর্থক দেশগুলিতে এই চাপগুলি আরও শক্তিশালী। অন্যদিকে জার্মানি, ফ্রান্স বা হাঙ্গেরির মতো দেশগুলিতে, যেখানে ইহুদিবাদী লবি শক্তিশালী সেখানে ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়া কঠিন কাজ।#
পার্সটুডে/এমআরএইচ/১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।