এপ্রিল ১৯, ২০২৩ ১৪:৩৫ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা আর-রহমানের ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তাফসির শুনেছি। আজ আমরা এই সূরার ১৯ থেকে ৩০ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। 

مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ (19) بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لَا يَبْغِيَانِ (20) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (21)

প্রথমেই ১৯ থেকে ২১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“তিনি প্রবাহিত করেন [মিষ্টি ও লোনা পানির] দুই সমুদ্র যারা পরস্পর মিলিত হয়।” (৫৫:১৯)

“[কিন্তু] তাদের উভয়ের মধ্যে রয়েছে এক অন্তরাল যা তারা অতিক্রম করতে পারে না [এবং পরস্পর মিলিত হতে পারে না]।” (৫৫:২০)

“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহে মিথ্যারোপ করবে?”(৫৫:২১)

আগের আয়াতগুলোতে বর্ণিত নেয়ামতরাজির ধারাবাহিকতায় এই আয়াতগুলোতে সমুদ্রের নিয়ামত বর্ণনা করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তিন চতুর্থাংশেই রয়েছে সাগর ও মহাসাগর। মাছসহ অন্যান্য সামুদ্রিক খাবারের বিশাল উৎস এই সাগর ও মহাসাগর এবং এই সাগরপথ ব্যবহার করে মানুষ জাহাজ চালিয়ে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মানুষ ও পণ্য পরিবহন করে। এছাড়া, আকাশ থেকে বারি বর্ষণ, আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা এমনকি ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত বাতাসের একটি বিশাল অংশ এই সাগরের কল্যাণে প্রবাহিত হয়।

এখানে কোনো কোনো সাগরের একটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: সাগরের কোনো কোনো স্থানে লবণাক্ত ও মিষ্টি পনি পাশাপাশি প্রবাহিত হয় কিন্তু তারা পরস্পর মিলিত হয় না। মনে হয় যেন তাদের মধ্যে এমন কোনো প্রাচীর রয়েছে যার কারণে এই দুই ধরনের পানি পরস্পর মিলিত হতে পারছে না। এখানে উদাহরণ হিসেবে আটলান্টিক মহাসাগরের গাল্‌ফ স্ট্রিমের কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে বিষুবরেখার কাছাকাছি হাজার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পানির একটি প্রবাহ রয়েছে যা উষ্ণ। এই পানির প্রবাহ মধ্য আমেরিকা থেকে শুরু করে উত্তর ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দুই পাশের পানির তুলনায় এই পানি ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি উষ্ণ। এই উষ্ণ পানি দুই পাশের তুলনামূলক শীতল পানির সঙ্গে না মিশেই হাজার হাজার কিলোমিটার পথ প্রবাহিত হয়।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- প্রকৃতি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার বিশাল ক্ষমতা ও অসীম রহমতের প্রদর্শনস্থল। সাগর ও মহাসাগর হচ্ছে আল্লাহর এরকম একটি বিস্ময়কর সৃষ্টি।

২- প্রকৃতি কীভাবে চলবে তার নিয়ম-কানুন আল্লাহই ঠিক করে দেন। প্রকৃতি নিজে নিজে কাজ করতে বা আল্লাহর নির্দেশের বাইরে কিছু করতে পারে না। তরল পদার্থের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সাগরের লবণাক্ত ও মিষ্টি পানির পরস্পরে মিলিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে সাগর ও মহাসাগরে এই দুই পানি একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হয় না।

এবারে সূরা আর-রহমানের ২২ থেকে ২৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ (22) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (23) وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنْشَآَتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ (24) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (25)

“উভয় [সমুদ্র] থেকে উৎপন্ন হয় মণিমুক্তা ও প্রবাল।” (৫৫:২২)

“অতএব তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামত অস্বীকার করবে?”(৫৫:২৩)

“আর সাগরে বিচরণশীল পৰ্বতপ্রমাণ নৌযানসমূহ তারই নিয়ন্ত্রণাধীন।”(৫৫:২৪)

“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহে মিথ্যারোপ করবে?”(৫৫:২৫)

এই আয়াতগুলোতে মানুষের জীবনে সাগরের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলা হচ্ছে: মনিমুক্তা ও প্রবালের মতো মূল্যবান পাথর মানুষের বিভিন্ন উপকারে আসে। তবে এগুলো সমুদ্রের গভীরতম স্থান থেকে সংগ্রহ করতে হয়। মুক্তা হচ্ছে সবচেয়ে দামী পাথর যা সাগরে বিচরণকারী ঝিনুকের মধ্যে পাওয়া যায়। অতীতে সাগর তীরে বসবাসকারী মানুষের জীবিকার অন্যতম উপায় ছিল মুক্তা সংগ্রহ ও বিক্রি করা। তবে সাগরের সবচেয়ে কার্যকর উপকারিতা হচ্ছে এর বুক চিড়ে বিশাল বিশাল পর্বতসমান জাহাজ চলাচল। বর্তমান যুগে আকাশপথে যোগাযোগ অনেক সহজ ও দ্রুত হওয়া সত্ত্বেও অনেক বেশি পরিমাণ পণ্য বিশ্বের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজে এখনও জাহাজ ব্যবহৃত হয়। কাজেই পণ্য পরিবহনে সাগর মানুষের অপরিসীম উপকার করে।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- মানুষ স্থলভাগে বসবাস করলেও সাগর ও মহাসাগর তাদের অনেক উপকারে আসে। সাগর থেকে মূল্যবান পাথর সংগ্রহ করার পাশাপাশি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পণ্য পরিবহনের কাজে সাগরপথ ব্যবহার করা হয়।

২- যারা আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তারা কীভাবে জল, স্থল ও আকাশভাগের এতসব নিয়ামতকে দেখেও না দেখার ভান করে?

এবারে এই সূরার ২৬ থেকে ৩০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:(৫৫:২৬)

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ (26) وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ (27) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (28) يَسْأَلُهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ (29) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (30)

“যমীনের উপর যা কিছু রয়েছে, তার সবই ধ্বংসশীল।”(৫৫:২৬)

“অবিনশ্বর [শুধু] তোমার মহিমাময়, মহানুভব প্রতিপালকের সত্তা।”(৫৫:২৭)

“অতএব তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামত অস্বীকার করবে?”(৫৫:২৮)

“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তারা (নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যা কিছু দরকার তা) তাঁর কাছেই চায়, প্রতি দিন তিনি নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।”(৫৫:২৯)

“অতএব তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামত অস্বীকার করবে?” (৫৫:৩০)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই চার আয়াতে পৃথিবীতে মানুষের অল্প কয়েকদিনের জীবনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে মানুষের সবকিছু শেষ হয়ে যায় এবং মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার কোনো হাতিয়ার যে মানুষের হাতে নেই সেই মানুষ মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার সামনে কীভাবে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করে এবং তার নিয়ামতগুলো অস্বীকার করে?

পৃথিবী এবং এর উপরে যা কিছু বসবাস করে তা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল এবং ক্রমেই ধ্বংসের দিকে অগ্রসরমান। কিন্তু যে বিষয়টি অতীতেও ছিল এবং অনন্তকাল থাকবে তা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পবিত্র সত্ত্বা। ইনি হলেন সেই আল্লাহ যিনি সকল পূর্ণতার আধার এবং গোটা বিশ্বজগতের স্রষ্টা। প্রতিটি সৃষ্টি তাঁর প্রতি সার্বক্ষণিকভাবে নির্ভরশীল এবং যার যার ভাষায় তাদের চাহিদার কথা আল্লাহকেই বলে থাকে। যা কিছু চাওয়ার তা সবাই আল্লাহর কাছেই চায়। সেটা মুখে বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এমনকি যে আল্লাহর অস্তিত্বে অস্বীকার করে তারও চাওয়ার স্থান ওই একটিই।

এই পাঁচ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মৃত্যু হচ্ছে এমন একটি সার্বজনীন বিধান আল্লাহ ছাড়া আর সবাই যার অধীনে রয়েছে।

২- আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া আর কারো ওপর নির্ভর না করি কারণ তিনি ছাড়া বাকি সব কিছু ধ্বংসশীল।

৩- এই বিশ্বজগত একদিকে যেমন মহান আল্লাহর গৌরব ও মহানুভবতা প্রদর্শনস্থল তেমনি সৃষ্ট বস্তুর প্রতি আল্লাহর রহমত এবং দয়াও প্রকাশ পেয়েছে এখানেই।

৪- যে আল্লাহ এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন তিনি তার সৃষ্টিকে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়ে রাখেননি বরং নিজ প্রজ্ঞা অনুযায়ী এই জগত পরিচালনার দায়িত্বভারও নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।

 

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।