মানুষের সন্তান কথাটি বাইবেল বা ইঞ্জিলে ৮০ বার এসেছে
শেষ ত্রাণকর্তা-৫(ইভাঞ্জেলিস্টরা কেন ইসরাইলপন্থী?)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা শুনেছি শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা খ্রিস্ট ধর্মের বেশ গভীরে স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য খ্রিস্ট ধর্মের বর্ণনাগুলোতে নানা ধরনের পার্থক্য ও অস্পষ্টতা দেখা যায়। এর কারণ নানা ধরনের বাইবেল লেখা হয়েছে হযরত ঈসার জন্মের ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার অনেক বছর পরে।
খ্রিস্ট ধর্মের দৃষ্টিতে শেষ ত্রাণকর্তা গোটা মানবতাকে মুক্ত করতে আসবেন। তাঁর বাণী শান্তির, ন্যায়ের, মৈত্রীর ও আধ্যাত্মিকতার। তিনি গোটা বিশ্ব থেকে দূর করবেন সব নৈতিক অনাচার, বৈষম্য ও জুলুম। মুসলমানরাও মনে করেন শেষ ত্রাণকর্তা বা ইমাম মাহদির ব্যক্তিত্বের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকবে। খ্রিস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে শেষ ত্রাণকর্তাকে 'মানুষের সন্তান' ও কখনওবা 'সঠিক বা প্রকৃত আত্মা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে দেখা যায় হযরত ঈসা নিজেই এ ধরনের পরিভাষা ব্যবহার করেছেন শেষ ত্রাণকর্তা বোঝাতে। তিনি হযরত ঈসার পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন বলেও এই মহান নবী উল্লেখ করেছেন, ফলে জনগণও সে সময় তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।
জেমস হকস পবিত্র গ্রন্থের অভিধান শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, মানুষের সন্তান কথাটি বাইবেল বা ইঞ্জিলে ৮০ বার এসেছে। এসবের মধ্যে কেবল ত্রিশ বার এ শব্দটি হযরত ঈসার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়। খ্রিস্টানরা মনে করেন শেষ ত্রাণকর্তা আল্লাহর পুত্র, তিনি মানুষের সন্তান নন!
খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মে শেষ ত্রাণকর্তার যেসব চিত্র পাওয়া যায় সেসবের অভিন্ন দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে উভয়ই একই ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তাঁদের কাজও একই ধরনের এবং একই ধরনের পরিবেশে তাঁরা আসবেন বা আবির্ভূত হবেন। এ দুই ধর্মই বিশ্বাস করেন যে শেষ ত্রাণকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসবেন। তবে তারা ঠিক কখন কোন্ সনে আসবেন তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তা ও মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থের বর্ণনাগুলোতে উল্লেখিত শেষ ত্রাণকর্তা তথা ইমাম মাহদি (আ) বিশ্বব্যাপী জুলুম ও বৈষম্য ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হবেন।
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তা ও মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তা উভয়ই ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁদের সরকার ও রাষ্ট্র হবে ন্যায়বিচার, সাম্য, জনকল্যাণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসাধারণ সমৃদ্ধি-ভিত্তিক এবং পরিপূর্ণতা-ভিত্তিক। তাঁরা হবেন বিশ্ব-বিপ্লবের মহানায়ক। অবশ্য খ্রিস্টিয় উনবিংশ শতকের শেষের দিকে প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের মধ্যে এমন এক গ্রুপের আবির্ভাব হয় যাদের কথিত শেষ ত্রাণকর্তার মধ্যে অতীত যুগের খ্রিস্টানদের প্রচারিত শেষ ত্রাণকর্তার সেইসব সুপরিচিত বৈশিষ্ট্যগুলো আর দেখা যায় না! এই গ্রুপটি ইহুদিবাদী খ্রিস্টান নামে পরিচিত। তাদের দৃষ্টিতে শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের প্রাক্কালে ও এর আগে বেশ ভয়ানক আর অমানবিক অনেক ঘটনা ঘটবে। ইহুদিবাদী খ্রিস্টবাদে বিশ্বাসীরা তথা ইহুদিবাদী খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা মাসিহকে সামরিক ও রুক্ষ প্রকৃতির ব্যক্তিত্ব বলে প্রচার করছে। তাদের মতে হযরত ঈসা ফিরে এসে অনেক মানুষকে বিশেষ করে মুসলমানদেরকে হত্যা করবেন! ইহুদিবাদী খ্রিস্টানরা ইভাঞ্জেলিস্ট নামেও পরিচিত। তাদের মতে ইহুদিরা অন্যান্য জাতির তুলনায় সেরা তথা তারা আল্লাহর মনোনীত খাস জাতি!
ইভাঞ্জেলিস্ট গোষ্ঠী খ্রিস্টানদের মধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ও মুক্তিপ্রাপ্ত বলে মনে করে! আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইভাঞ্জেলিস্টদের একটি মূল নীতি। ইভাঞ্জেলিস্টরা মনে করে ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদীদের দখলদারিত্ব বৈধ ও এটা তাদের অধিকার! তাদের দৃষ্টিতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার বলতে কিছু নেই! আর এ কারণেই তারা ইহুদিবাদী ইসরাইলকে সর্বাত্মক ও পরিপূর্ণ সহযোগিতা দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী যাতে ইহুদিবাদীরা মিশরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফোরাত তথা ইউফ্রেতিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল দখল করতে পারে। ইহুদিবাদী খ্রিস্টানরা মনে করে মুসলমানদের প্রথম কিবলা তথা আল-আকসা মসজিদকে ধ্বংস করতে হবে এবং এর ওপর নির্মাণ করতে হবে হযরত সুলাইমানের উপাসনালয়! ইহুদিবাদীরাও এই ধ্বংসাত্মক বিষয়টির ওপর অশেষ জোর দিয়ে আসছে এবং বহু বছর ধরে এই ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংসের চেষ্টা করছে। ইভাঞ্জেলিস্টরা মনে করে হযরত সুলাইমানের ইবাদত-কেন্দ্র হযরত ঈসার রাষ্ট্র বা শাসন-যন্ত্রের কেন্দ্রীয় দপ্তর। তাই তারা আল-আকসা তথা মুসলমানদের প্রথম কিবলা ধ্বংসের ইসরাইলি প্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের প্রতি ব্যাপক সমর্থন জানিয়ে আসছে!
ইহুদিবাদী খ্রিস্টানরা তথা ইভাঞ্জেলিস্টরা মনে করে আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই মসজিদ ভাঙ্গতে গেলে যুদ্ধ শুরু হতে পারে এবং তারা এই যুদ্ধকে স্বাগত জানায়। কারণ তাদের বিশ্বাস এই যুদ্ধই হবে আরমাগেড্ডনের মহাযুদ্ধের সূচনা এবং এর ফলে খ্রিস্টানদের ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটবে। এই মহাযুদ্ধ শুরু হবে বায়তুল মুকাদ্দাসে এবং এই উপলক্ষে হযরত ঈসা পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। হযরত ঈসা কেবল দ্বিতীয়বার জন্ম-নেয়া খ্রিস্টানদেরকে নিজের সঙ্গে করে বেহেশতে নিয়ে যাবেন। অনিষ্টতা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রতীক দাজ্জাল যখন আর্মাগেড্ডন যুদ্ধে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখনই হযরত ঈসা সেইসব মুক্তিপ্রাপ্ত খ্রিস্টানদের নিয়ে ফিরে আসবেন এবং দাজ্জালের বাহিনীকে নির্মূল করবেন। আর এভাবে হযরত ঈসার এক হাজার বছরের রাষ্ট্রীয় শাসন শুরু হবে। ইভাঞ্জেলিস্টদের এইসব বিশ্বাসকে বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান সত্য বলে মনে করলেও অনেক খ্রিস্টান মনে করে হযরত ঈসার রাষ্ট্র এই পৃথিবীতে নয় বরং তা হবে উর্ধ্বজগতে বা পরকালে। ইভাঞ্জেলিস্টদের ধারণা প্রতিশ্রুত শেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের নানা লক্ষণের কোনো কোনোটি এরিমধ্যে দেখা গেছে। অন্যদিকে অন্য খ্রিস্টানরা মনে হযরত ঈসার পুনরাবির্ভাবের সময় নির্ধারণ করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ।
খ্রিস্ট ধর্মের নন-ইভাঞ্জেলিস্ট ধারাগুলো মনে করে শেষ ত্রাণকর্তা গোটা মানবতাকে মুক্ত করতে আসবেন। তাঁর বাণী শান্তির, ন্যায়ের, মৈত্রীর ও আধ্যাত্মিকতার। অথচ ইহুদিবাদী খ্রিস্টবাদে বিশ্বাসীরা তথা ইহুদিবাদী খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা মাসিহকে সামরিক ও রুক্ষ প্রকৃতির ব্যক্তিত্ব বলে প্রচার করছে। চরমপন্থি এই গোষ্ঠীর মতে হযরত ঈসা ফিরে এসে অনেক মানুষকে বিশেষ করে মুসলমানদেরকে হত্যা করবেন এবং তিনি কেবল দ্বিতীয়বার জন্ম-নেয়া খ্রিস্টানদের মুক্ত করবেন! তাদের মতে মুসলমানরা হচ্ছে দাজ্জালের বাহিনী! ইহুদিবাদী খ্রিস্টান তথা ইভাঞ্জেলিস্টরা অন্য ধারার খ্রিস্টানদের কাছে তাদের চরমপন্থি বিশ্বাসগুলোকে গ্রহণযোগ্য করতে ব্যাপক প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে এবং নানা ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ও জর্জ ডাবলিও বুশও ছিলেন ইভাঞ্জেলিস্ট। এ দুই রাষ্ট্রপতি ইভাঞ্জেলিস্টদের বিশ্বাসগুলো বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ব-শান্তির প্রতি অনেক হুমকি ও আঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। এই গোষ্ঠী মনে করে যে শেষ যুগের ঘটনা-প্রবাহে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের ভূমিকা থাকবে। কিন্তু এই গোষ্ঠীর অনেক ভবিষ্যদ্বাণী বা কথিত অনেক লক্ষণ মিথ্যা বলে প্রমাণ হয়েছে।
ইভাঞ্জেলিস্টদের ধারণার বিপরীতে ইসরাইল শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে দিনকে দিন দুর্বল হচ্ছে। আল-আলআকসাকে ধ্বংস করার ইসরাইলি পরিকল্পনা ঠেকাতে ফিলিস্তিনের অধিবাসীরাসহ মুসলমানরা যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে তাতে ইহুদিবাদী খ্রিস্টান-চক্র ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে।
হ্যাঁ, ইমাম মাহদি (আ.) ও তাঁর অনুরাগীদের শক্তির উৎস হচ্ছে তাকওয়া বা খোদাভীতি। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।