মার্কিন নও-মুসলিম আফ্রা ও এলিজাবেথের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
নওমুসলিমদের আত্মকথা অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ আমরা মার্কিন নও-মুসলিম আফ্রা আশশাইবানি এবং এলিজাবেথ এডওয়ার্ডস-এর ধর্মান্তরিত হওয়ার কাহিনীসহ তাদের কিছু বক্তব্য ও চিন্তাধারা তুলে ধরব।
মিসেস আফ্রাহ আশশাইবানি ছিলেন মিশিগান ক্রিশ্চিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ঘটনাক্রমে তিনি ও তার প্রিয় রুমমেট মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকজন মুসলিম মহিলার সঙ্গে পরিচিত হন ও তাদের সঙ্গে আফ্রাহ'র বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। একদিন আফ্রাহ'র রুমমেট তাকে জানান যে, তিনি মুসলমান হয়ে গেছেন। এ কথা শুনে দুঃখিত ও ক্ষুব্ধ আফ্রাহ চিঠি লিখে তাকে এই পথ থেকে টলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। এরপর আফ্রাহ সিদ্ধান্ত নিলেন, যে কোনোভাবেই হোক বান্ধবী যে ভুল করেছেন সেটা তার কাছে প্রমাণ করবেন। এই লক্ষ্য নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন আফ্রাহ। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে যেসব বই তিনি পড়ছিলেন সেগুলো ছিল অমুসলমানদের লেখা ও বিদ্বেষপূর্ণ মতামতে ভরপুর। ফলে ইসলাম সম্পর্কে আফ্রাহর ধারণা ক্রমেই আরো খারাপ হচ্ছিল। সদ্য-বিবাহিত আফ্রাহ নিজ বান্ধবীকে 'বিচ্যুতি থেকে সুপথে' ফিরিয়ে আনার জন্য স্বামীর সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীর সহযোগিতা চেয়ে আফ্রাহ দ্বিতীয়বার শক খেলেন।
আফ্রাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন: "আমার স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বিষয়ে পড়াশোনা করতেন সেসবের মধ্যে কয়েকটি ইউনিট ছিল বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষা সম্পর্কিত। তিনি জানিয়ে দেন যে, যতই ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা ও গবেষণা করছিলেন ততই এ ধর্ম সম্পর্কে তার অতীত ধারণাগুলো বদলে যাচ্ছে। কিছু দিন পর আমার স্বামীও মুসলমান হয়ে যান। ফলে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার স্বামী বেশ কিছুকাল ধরে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করেছেন।"
এভাবে আফ্রাহ তার ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তির মুখোমুখি হলেন যারা খ্রিস্ট ধর্ম ছেড়ে দিয়ে মুসলমান হয়েছেন। এদের মধ্যে স্বামীকে আবার বুঝিয়ে শুনিয়ে খ্রিস্ট ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করেন আফ্রাহ।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "ইসলাম সম্পর্কে যেসব বই-পুস্তক পড়েছিলাম সেগুলো আমার স্বামীকে পড়তে দিয়ে বললাম: আমি কখনও ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব না। আমার স্বামী বেশ মনোযোগ দিয়ে সেসব বই পড়ে বললেন: এই বইগুলো অমুসলমানরা লিখেছেন। ইসলাম সম্পর্কে বিকৃত বা মিথ্যা ধারণা তুলে ধরার জন্য বিদ্বেষবশত অথবা অজ্ঞতা নিয়ে এইসব বই লেখা হয়েছে। এইসব ধারণা ইসলামের বাস্তবতার পুরোপুরি বিপরীত। যদি বাস্তবতা জানতে চাও তাহলে ইসলামের মূল বা সত্যিকার শিক্ষার উৎস হিসেবে বিবেচিত বইগুলো পড়তে হবে কিংবা ইসলাম সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের কাছে প্রশ্ন করতে হবে।"
মার্কিন এই নওমুসলিম আরো বলেছেন, "আমি অযৌক্তিক আচরণ করতে চাচ্ছিলাম না। তাই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের লেখা নানা বই-পুস্তক পড়তে লাগলাম। আর যতই পড়াশোনা করছিলাম ততই বুঝতে পারছিলাম যে সত্যিকারের ইসলাম ও অমুসলিম সূত্রে বর্ণিত ইসলামের মধ্যে সাগরগুলোর মত বিস্তৃত ব্যবধান রয়েছে। যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে ও ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে তা হল, মুসলমান হওয়ার পর আমার স্বামীর চলাফেরা ও আচার-আচরণ এবং মানসিক অবস্থায় পরিবর্তন।"
মার্কিন নওমুসলিম আফ্রাহ আরো বলেছেন, "মুসলমান হওয়ার পর আমার স্বামী আগের চেয়েও বেশি আন্তরিক, ভদ্র ও ভালো আচরণকারী হলেন। অত্যন্ত যত্নসহকারে ও যথাযথভাবে কাজকর্ম করতে লাগলেন এবং অন্যদের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা অনুভব করছিলেন। তিনি যখন নামাজে দাঁড়াতেন তখন যেন তার মধ্যে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত ও তার দৃষ্টিতে দেখা যেত সজীবতা। তাই আমি জানার চেষ্টা করলাম ইসলামী শিক্ষার মধ্যে এমন কী কী বিষয় লুকিয়ে আছে যা মানুষকে এভাবে বদলে দেয়?"
ইসলামের যে বিষয়টি মার্কিন নও-মুসলিম আফ্রা আশশাইবানিকে অভিভূত করেছে তা হল, ইসলামী শিক্ষা ও সেই শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়ন করার মধ্যে পরিপূরক সম্পর্ক।
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "ইসলামের শিক্ষাগুলোর দৃষ্টান্ত এলোমেলো নানা অক্ষর মিলিয়ে শব্দের পাজেল তৈরি করার মত সুন্দর ও অর্থপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমি তখনও আমার গোঁড়ামি ছাড়তে পারিনি। তাই মুসলমান হয়েছেন বলে তখনও আমার স্বামীকে ব্যাপক উত্যক্ত করছিলাম এবং বান্ধবীরও সমালোচনা করছিলাম। আমি নিজেই যে ভুল পথে আছি তা স্বীকার করা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল। এ নিয়ে যখন বিবেকের সঙ্গে লড়াই করছিলাম তখন ইসলামের নম্রতা ও বিনয়ের শিক্ষা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করল। বিশেষ করে ইসলামের এই নীতিটি আমার কাছে খুব ভালো লাগল যে, সত্যের কাছে মানুষের বিনম্র হওয়া উচিত এবং অহংকার করা উচিত নয়।"
মার্কিন নও-মুসলিম আফ্রা আশশাইবানি এ প্রসঙ্গে আরো বলছিলেন: "আমার বিবেকেও এতে সায় দিল যে অহংকার মানুষের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর অহংকার ঝেড়ে ফেললে পূর্ণতা ও অগ্রগতির পথ খুলে যায়। অবশেষে আমি আমার অহংবোধের বিজয়ী হই। আমি আমার স্বামী ও বান্ধবীকে এ সুসংবাদ দিলাম যে, আমিও মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছি এবং ইসলামকে ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছি। এ সংবাদ আমার স্বামী ও বান্ধবীর জন্য ছিল অবিশ্বাস্য। ফলে তাদের খুশির যেন আর অন্ত রইল না। এ ঘটনার পর আমি আফসোস করছি যে, হায়! আমি যদি প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ থাকতাম ও আরো আগেই সৌভাগ্যের পথ খুঁজে পেতাম!"
আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা আরো একজন মার্কিন নও-মুসলিম মহিলার সঙ্গে পরিচিত হব। মিসেস এলিজাবেথ এডওয়ার্ডস নামের এই নারী মনে করেন, তিনি যতই ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করছেন ততই এ বিশ্বজগতের প্রতিপালক সম্পর্কে বেশি জানতে পারছেন এবং আল্লাহর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও বাড়ছে।
ইসলামের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি প্রসঙ্গে এলিজাবেথ বলেছেন:
"আমি মুসলমান হওয়ার ৫ বছর আগেই আমার এক খালা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমার কাছে আল্লাহ ও ইসলাম সম্পর্কে কথা বলতেন। আর এইসব কথা আমার কাছে খুবই ভালো লাগত। অবশ্য তখনও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মত বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত ছিলাম না, এ ব্যাপারে কিছুটা ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে চাচ্ছিলাম। আমি পড়াশোনা করেছিলাম ক্যাথলিক স্কুলে। যে বিষয়টি আমাকে ইসলামের দিকে বেশি ঘনিষ্ঠ করেছে তা হল, আমার খালা ছিলেন ম্যালকম এক্সের ভক্ত। খালার কাছে যখন এই ব্যক্তিত্বের কথা শুনতাম তখন বেশ উদ্দীপ্ত হতাম এবং এইসব কথা আমাকে বদলে দিত।"
মার্কিন নও-মুসলিম এলিজাবেথ এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন: "ম্যালকম এক্স ইসলামের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে মার্কিন সমাজের ব্যাপক-বিস্তৃত বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। তার ন্যায়বিচারকামিতা ও জুলুম-বিরোধী চেতনা আমাকে ইসলামের দিকে আরো বেশি আকৃষ্ট করেছে। ম্যালকম এক্স বলতেন, ইসলাম আপনাকে কেবল ভালো মানুষ হতেই বলে না, একইসঙ্গে জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও বলে। যে মানুষ জুলুমের কাছে নতজানু হয় তাকে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন না।"
নওমুসলিম এলিজাবেথের মতে, ইসলাম তাকে দিয়েছে প্রশান্তি। তিনি বর্তমানে ইসলাম সম্পর্কে ইংরেজিতে অনূদিত নানা বই-পুস্তক পড়ছেন। সম্প্রতি তার হাতে আয়াতুল্লাহ আমিনির লেখা একটি বই পৌঁছেছে। বইটি এলিজাবেথকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। তিনি মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে পবিত্র কুরআন ও ইসলাম সম্পর্কিত বই-পুস্তক পড়ার আহ্বান জানান। এলিজাবেথ বলেছেন, এইসব বই পড়ার মাধ্যমে জীবনে অনেক মূল্যবান জ্ঞান ও ভাবধারা অর্জন করা সম্ভব।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৩