খোদাপ্রেমের অনন্য মাস রমজান (পর্ব-৯)
রোজা হচ্ছে নিজ বান্দা ও মুমিনদের প্রতি মহান আল্লাহর এক উপহার। তাই রোজাকে একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখা উচিত নয়, বরং একে দাসের প্রতি আল্লাহর উচ্চ মর্যাদা প্রদান ও সম্মান প্রদর্শন হিসেবে দেখা উচিত। আর এ জন্য আমাদের উচিত আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
জীবন প্রত্যেক মানুষের অমূল্য সম্পদ। মানুষের সব কল্যাণ এই জীবনের মাধ্যমেই আসে। জীবন বা আয়ু হল দ্রুত অতিক্রান্ত হওয়া কিছু ঘন্টার সমষ্টি। এটা এমন এক পুঁজি যা আনতে পারে চিরস্থায়ী সৌভাগ্য ও বেহেশত। আমাদের উচিত জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং জীবনের রাত ও দিনগুলোর দ্রুত শেষ হয়ে আসা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। জীবন বা আয়ু হচ্ছে এক বরফ খণ্ড এবং প্রখর সূর্যের তাপ এই পুঁজিকে দিনকে দিন গলিয়ে ছোট করছে। পরকালের সৌভাগ্য অর্জনের জন্য এই আয়ু কোন্ উদ্দেশ্যে, কিভাবে ও কোথায় ব্যবহার করা উচিত? আল্লাহ আমাদের ওপর রোজা ফরজ করেছেন যাতে আমরা খোদাভীতি অর্জনে সচেষ্ট হই।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাইনুল আবেদিন (আ)’র "মাকারেমুল আখলাক্ব" শীর্ষক একটি দোয়া আধ্যাত্মিক উন্নতিতে আগ্রহী ব্যক্তির জন্য অমূল্য সম্পদ।
এই দোয়ার প্রথম দিকে বলা হয়েছে, "হে আল্লাহ! আমাকে সৎকর্মশীল বান্দার অলংকার ও সাজ-সজ্জা তথা তাদের সব গুণ দান কর, দান কর খোদাভীতি। এই বাক্যগুলোর পর ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ২৩টি বিষয় উল্লেখ করেছেন যেগুলো খোদাভীতির অর্থ বা দৃষ্টান্তের কিছু দিক। যেমন, "ফি বিসাতিল আদল" বা ন্যায়বিচার বিস্তৃত করা। অর্থাৎ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিচার বিভাগে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দেশের প্রধান সম্পদগুলো জনগণের মধ্যে বণ্টন করা, জনগণের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার সমবণ্টন হচ্ছে ন্যায়বিচারের কিছু দৃষ্টান্ত। এ দোয়ার আলোকে খোদাভীরু ও সংযমী লোকদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, তারা তাদের ক্রোধ প্রশমিত করে।
পবিত্র কুরআন ক্রোধ প্রশমনকারী ও মানুষকে ক্ষমাকারী ব্যক্তিদের সৎকর্মশীল বলে অভিহিত করেছে। খোদাভীরুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তারা মানুষের মধ্যে শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করেন।
বিভিন্ন গ্রুপ, দল ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মতবিরোধের আগুন আরো প্রজ্জ্বলিত করা খোদাভীরু হওয়ার লক্ষণ নয়। বরং হিংসা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়নতা বা জিঘাংসা দূর করে তাদেরকে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ করা খোদাভীরুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
"শ্রেষ্ঠ নৈতিক গুণাবলী" শীর্ষক দোয়ার আলোকে মানুষের ভালো গুণ ও কাজগুলো তুলে ধরা এবং দোষগুলো ঢেকে রাখা বা ফাঁস না করা খোদাভীরুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এটা করতে গিয়ে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ বন্ধ করা যাবে না। যাদের কাজকর্ম ত্রুটিপূর্ণ তাদেরকে সেটা ধরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেটা ফাঁস করা বা প্রচার করা ঠিক নয়।
বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, মানুষের সেরা নৈতিক গুণগুলোকে পূর্ণতার শিখরে পৌঁছে দেয়াই ছিল তাঁর মিশন। "শ্রেষ্ঠ নৈতিক গুণাবলী" বলতে কেবল উন্নত নৈতিক চরিত্র বা সৎ স্বভাবকেই বোঝায় না। তিনি এ ধরণের গুণের কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। যেমন, যে তোমাকে কস্ট দিয়েছে তাকে ক্ষমা কর, যে তোমায় বঞ্চিত করেছে তাকে দান কর, যে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছে তাকে কাছে টান, তোমার অসুস্থতার সময় তোমাকে দেখতে আসেনি, তুমি তার অসুস্থতার সময় তাকে দেখতে যাও।
মুসলমানরা পবিত্র কুরআনের আলোকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে জীবনের সবক্ষেত্রে সর্বোত্তম আদর্শ বলে স্বীকার করে নিলেও বাস্তব জীবনে আমাদের অনেকেই পশ্চিমা পুঁজিবাদ, কথিত উদার গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ বা সমাজতন্ত্রের মত ত্রুটিপূর্ণ জীবনাদর্শকে মুসলিম প্রধান দেশেও রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। তাহলে এই ব্যক্তিরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে জীবনের সবক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ বলে মানছেন কি? আসলে আমরা কখনও জ্ঞানের অভাবে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোভাবে চেনা-জানার অভাবে এবং কখনওবা শয়তানের কুমন্ত্রণার কাছে পরাস্ত হওয়ার কারণে ও কখনওবা কুপ্রবৃত্তিকে দমনের অভ্যাস না থাকার কারণে নানা ধরনের পাপে জড়িত হচ্ছি। কখনওবা ব্যক্তিগতভাবে, কখনওবা পারিবারিকভাবে ও কখনওবা সামাজিকভাবে পাপে জড়িত হচ্ছি আমরা। সাংস্কৃতিক পাপও কম ভয়ানক নয়। যে চলচ্চিত্র, যে বই বা যে কার্টুন ও গেইম নিজের জন্য এবং শিশু-কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর তা আমরা এড়িয়ে চলছি না সচেতনতার অভাবে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সবক্ষেত্রে খোদাভীতি ও খোদাপ্রেমের সচেতনতা বজায় রাখার তৌফিক দান করুন। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৪