অক্টোবর ০৬, ২০১৭ ২১:২৪ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-৩১

শায়খ আশরাকের মূল নাম আবুল ফাতহ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দি। তিনি হিজরি ৫৪৯ সালে ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় যানজনের পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

 ইরানী এই দার্শনিক মারাগেহ এবং ইস্ফাহানে লেখাপড়া করেন। এখানেই তিনি বু আলি সিনার চিন্তাদর্শের সাথে পরিচিত হন। সোহরাওয়ার্দি তাঁর সমকালে একজন নামকরা জ্ঞানী-গুণী-মনীষী ছিলেন। দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, উসূলে ফিকাহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্র মারাগেহ'তে শায়খ মাজদুদ্দিন গিলানির কাছে পড়েন। সমকালীন দর্শনের জগতে তাকে একক এবং অনন্য বলে মনে করা হতো, সেইসাথে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান এবং অর্জিত জ্ঞানের ভাণ্ডার বলেও তাঁকে গণ্য করা হতো। সোহরাওয়ার্দি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষ করে ইরান সফরে বের হন। এই সফরকালেই তিনি মরমিবাদ ও আধ্যাত্মিকতার সাথে পরিচিত হন এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে অর্থাৎ আত্মশুদ্ধির জন্যে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন।

সোহরাওয়ার্দি তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়াতেন। এভাবে বেড়াতে গিয়ে রোমে-বর্তমান তুরস্কে-বিখ্যাত দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ফখরুদ্দিন মার্দিনির সাথে তাঁর দেখা হয়। সেখানে তিনি কিছুদিন কাটান। তারপর পুনরায় তিনি তাঁর সফর শুরু করে তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চলীয় আনাতোলি এবং শামাতে যাতে। এরকমই এক সফর করেন সিরিয়াতেও। সেখানে ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলমান পক্ষের বিখ্যাত বীর সালাউদ্দিন আইয়্যুবির ছেলে মালেক জাহেরের সাথে দেখা হয়। মালেক জাহের সূফিদেরকে এবং শিক্ষিত লোকদেরকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি ইরানের এই তরুণ দার্শনিকের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁকে ওই হালাব শহরে রাখতে চাইলেন। সোহরাওয়ার্দিও মালেক জাহেরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এখানেই তিনি তাঁর ‘হেকমাতুল আশরাক' নামক বিশাল গ্রন্থটি রচনার কাজ শেষ করেন।

হালাব শহরে সোহরাওয়ার্দি কোনোরকম পরোয়া ছাড়াই তাঁর নিজস্ব চিন্তাদর্শন নিয়ে কথা বলতেন এবং ভিন্ন মতাদর্শীদের সাথে বাহাস বা বিতর্কে অংশ নিতেন। হালাবের ফকিহগণ সোহরাওয়ার্দির সাথে তর্কে পেরে উঠতে পারছিল না। সেজন্যে তারা তাকে অমুসলিম বা মুসলমান সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কৃত বলে সাব্যস্ত করলো এবং সালাউদ্দিন আইয়্যুবির কাছে চিঠি লিখে তাকে হত্যা করার আহ্বান জানালো। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দিকে কারাগারে বন্দী করা হয় এবং হিজরী ৫৮৭ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ইরানের সমকালীন বিখ্যাত দার্শনিক প্রফেসর ইব্রাহিম দিনানী সোহরাওয়ার্দির মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছেনঃ ‘সোহরাওয়ার্দিকে জরথ্রুস্ট ধর্মের অনুসারী হিসেবে অভিযুক্ত করে ধর্ম থেকে বিতাড়িত বলে সাব্যস্ত করা হয়,অথচ আমার দৃষ্টিতে সে ছিল মোল্লা সাদরার চেয়েও বড়ো মুসলমান এবং ইবনে সিনার চেয়েও বেশি গ্রহণযোগ্য। তাকেঁ হত্যার দায়িত্ব সালাউদ্দিন আইয়্যুবির ওপর চাপানো হয়েছে,এটাও একটা বড়ো ধরনের খেলা। আল্লাহ জানেন-সোহরাওয়ার্দি যদি দীর্ঘজীবী হতেন তাহলে কতো বরকতের উৎস হতে পারতেন।'

সোহরাওয়ার্দির মতবাদ যেহেতু বৃদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিপ্রমাণে বিশ্বাসী সেহেতু একে দর্শন বলে অভিহিত করা হয়। বৃদ্ধিবৃত্তিক এই দর্শন অনুযায়ী বুদ্ধিই কেবল চেনার মানদণ্ড নয় বরং স্বজ্ঞাও চেনার উচ্চতম একটি মানদণ্ড। এদিক থেকে আধ্যাত্মিকতার সাথে তার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ট। সোহরাওয়ার্দি বিশ্বাস করতেন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ না থাকলে গোমরাহ হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে তিনি তাঁর অনুসারীদের বলতেন ‘হেকমাতুল আশরাক' গ্রন্থটি যেন এমন কাউকে দেওয়া হয় যে নিজেকে বিচিত্র দূষণ থেকে বিশুদ্ধ রাখার তথা আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করেছে এবং প্রকৃত সত্যকে অর্জন করার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। সোহরাওয়ার্দি বিশ্বকে বহু মূল্যবান অনেক গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন।

এইসব বই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নযোগ্য। তাঁর রচনার সামগ্রিক বৈশিষ্ট্য হলো গদ্য-পদ্য, আয়াত-হাদিস,দর্শন আধ্যাত্মিকতা ইত্যাদির সমন্বয়-যার জ্ঞানগত এবং সাহিত্যিক মূল্যও অপরিসীম। তিনি তাঁর লেখালেখিগুলো যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে লিখতেন আবার কখনো উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাহায্যে কিংবা গল্পের আঙ্গিকে বর্ণনা করতেন। এ ধরনের ফার্সি কটি লেখার মধ্যে জিব্রাইলের ডানার শব্দ, রঙীন বিবেক,অচেনা আগন্তুকের গল্প,রশ্মিনামা এবং আল্লাহকে চেনা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

যেমনটি বলেছিলাম যে দর্শন বিষয়ক সোহরাওয়ার্দির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে হেকমাতুল আশরাক বা বোধিদর্শন। এই গ্রন্থটির সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হয়েছে ফরাশি মনীষী প্রফেসর হ্যানরি কুরবানের তত্ত্বাবধানে একদল গবেষকের হাতে। তাদের ঐ গবেষণা চমৎকারভাবে মুদ্রিতও হয়েছে। এই গ্রন্থটির গুরুত্বপূর্ণ দুজন ব্যাখ্যাকার হলেন শাহরযুরি এবং আল্লামা কুতুবুদ্দিন শিরাযি। সোহরাওয়ার্দি তাঁর বহু বইতে বিশেষ করে ‘অচেনা আগন্তুকের গল্প' এবং ‘সূফিদের কাতারে একদিন' বইগুলোতে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ফেরেশতাকে স্থাপন করেছেন। তিনি এই ফেরেশতা বলতে জিব্রাইল (আ) কেই বুঝিয়েছেন যিনি আল্লাহর নৈকট্যধন্য এবং যাঁর মাধ্যমে আল্লাহর বাণী বা ওহী তথা আল-কোরআনের শিক্ষা সর্বশেষ নবীকে দেওয়া হয়েছিল।

সোহরাওয়ার্দির দর্শনে শব্দের ব্যবহার অন্যরকম। সেখানে অপরিহার্য সত্ত্বা বা সত্ত্বা-এ ধরনের কোনো শব্দ দেখতে পাওয়া যায় না। এগুলো ছিল মোল্লা সাদরার দর্শনের মৌলিকত্ব। সোহরাওয়ার্দির দর্শনে ‘নূর' শব্দের ব্যবহার বাহুল্য লক্ষ্য করা যায়। আর আল্লাহ হলেন নূরের প্রধান উৎস। কোরআনের সাথে এ ধরনের শব্দের সাযুজ্য বেশি। যাই হোক আল্লাহকে নূর বলে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে সম্ভবত সোহরাওয়ার্দিই সর্বপ্রথম কোনো মনীষী। কোরআনে কারিমেও আল্লাহকে যমিন এবং আসমান সমূহের নূর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দি তাঁর ‘নুরুল আনোয়ার' নামক গ্রন্থে আল্লাহকে চেনা সংক্রান্ত বিতর্কের বিষয়টি উত্থাপন করেছেন এবং আল্লাহকে সেই বাস্তবতা বলে মনে করেন যেই বাস্তবতার ঔজ্জ্বল্য চোখকে ঝলসে দেয়। নুরুল আনোয়ার বা নিরঙ্কুশ নূর বলতে সেই সমগ্র অস্তিত্বকে বোঝায় সকল সৃষ্টি যেই উৎসমূল থেকে নিজেদের অস্তিত্ব লাভ করেছে। ফলে সৃষ্টির মর্যাদা নির্ভর করে অস্তিত্বের মূল উৎসের সাথে তার সম্পর্ক কতোটা ঘনিষ্ঠ তার ওপর। সোহরাওয়ার্দি সমগ্র বিশ্বকেই নূরের স্তর বা পর্যায় বলে মনে করেন। এদিক থেকে সোহরাওয়ার্দির ‘নূরুল আনোয়ার' ইবনে সিনার ‘অপরিহার্য সত্ত্বা' চিন্তার মতোই।

সোহরাওয়ার্দির দৃষ্টিতে মৃত্যুর পর মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে তার আত্মা বা রূহ দুনিয়াতে ভালো কাজ করেছে নাকি মন্দ কাজ করেছে। তাঁর মতে মানুষের আত্মা বা রূহটাও এক ধরনের নূর। এই নূর মানুষের মৃত্যুর পর যদি পুরস্কৃত হবার উপযুক্ত হয় তাহলে নূরুল আনোয়ারের সাথে মিলে যায়। সোহরাওয়ার্দি তাঁর সকল দার্শনিক সমাধান খুজেঁছেন কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে। যেসব চিন্তা কোরআন সমর্থিত নয় সেইসব চিন্তাকে তিনি বর্জন করেছেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৬