মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি- ৬৮: ওসমানী শাসনামলে ইসলামী সভ্যতা
ওসমানী শাসনামলেই ইসলামী সভ্যতার পুনর্বিকাশের সূচনা হয়। এ সময় ওসমানী সাম্রাজ্যের মূল অংশটি ছিল বর্তমান তুরস্ক থেকে শুরু করে বলকান উপদ্বীপের বিশাল ভূখণ্ড পর্যন্ত, অন্যদিকে গ্রিসের কেন্দ্রীয় অঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চল, সিরিয়া, মিশর এবং হেজাজ পর্যন্ত। তবে উল্লেখ্য যে হেজাজ ছাড়া বাকি ভূখণ্ড একটা সময় ছিল খ্রিষ্টানদের অধীনে।
হিজরি পঞ্চম শতকের সূচনা থেকে এই ভূখণ্ডের বেশিরভাগই ক্রুসেড যুদ্ধের পর মুসলমানদের করায়ত্ত হয়। এর ফলে এই ভূখণ্ডের খ্রিষ্টান অধিবাসীরা দীর্ঘ তিন শ’ বছর ধরে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। যেসব খ্রিষ্টান মুসলমান হয় নি তারা মুসলমানদের পাশাপাশি ওসমানী সাম্রাজ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে নিজেদের ধর্মকর্ম স্বাধীনভাবে চালিয়ে যায়। তাদের জন্যে বিশেষ গির্জার ব্যবস্থা ছিল। এই চমৎকার ব্যবস্থার কারণে ইউরোপীয় সরকারগুলো আর ওসমানী সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ কোনো ব্যাপারে নাক গলানোর সুযোগ পেল না। কারণ তারা একথা বলার কোনো অজুহাতই খুঁজে পায় নি যে, খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর সাথে মুসলমানরা বৈষম্য করছে কিংবা যথার্থ ব্যবহার করছে না ইত্যাদি।
ওসমানীদের সময়টা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চৌদ্দ শতক থেকে আর শেষ হয় সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত। ওসমান, উরখান, দ্বিতীয় মুরাদ এবং বিশেষ করে সুলতান মুহাম্মাদ ফাতেহ’র মতো শাসকদের সময় ছিল সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। এ সময় যেসব নীতি কাজে লাগানো হয়েছে ঐসব নীতির ফলে ওসমানী সাম্রাজ্য খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সামরিক এবং বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়। সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে ওসমানীদের একটি সাফল্য হলো বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও তারা হত্যাকাণ্ড কিংবা লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে নি। সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ সকল খ্রিষ্টানকে জান এবং মালের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতাও দিয়েছিল। খ্রিষ্টানদের প্রার্থনালয় গির্জাগুলো তাঁর নির্দেশে সুরক্ষিত হয়। সুলতানের এই বদান্যতার ফলে বহু খ্রিষ্টানও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন এমনকি বহু লাইব্রেরিও গড়ে তোলেন। শুধু তাই নয় ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের হুজুগে যেসব ইহুদি স্পেন, পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী কিংবা উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছিল, তারা ওসমানী সাম্রাজ্যে অভিবাসনের সুযোগ নেয় নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে।
ইসলামী সভ্যতার এই যুগে রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অঙ্গনগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল। সামরিক দিক থেকেও বলা যায় ওসমানী সামরিক ব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী হয়। সে সময় পর্যন্ত যেসব সামরিক বাহিনী ছিল হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, তারা ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়েছিল। নৌবাহিনীকেও একইভাবে তারা শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিল। সুলতান মুহাম্মদ ফতেহ বিভিন্ন দেশের সাথে সমুদ্র বাণিজ্যচুক্তিও করেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভেনিসের সাথে চুক্তি করে দারদানেল প্রণালীতে ভেনিসের বাণিজ্য তরীগুলোর স্বাধীনভাবে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই চুক্তির ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্যিক লেনদেনের জমকালো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল।
সুলতান মুহাম্মদ ফতেহ পশুপালন এবং কৃষিকাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেন। যেসব এলাকা তিনি জয় করেছিলেন সেসব এলাকাকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির চরম শিখরে নিয়ে যাবার জন্যে যার পর নাই চেষ্টা চালান। সেইসব অঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি প্রচুর বাণিজ্য কেন্দ্রও স্থাপন করেছিলেন। ওসমানী হুকুমতের নেতারা ইস্তাম্বুল, আদারনা এবং বুরসা-এই শহরগুলোকে রাজনৈতিক প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছিল যাতে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়। বড়ো বড়ো শহরগুলোকে এবং জনবহুল মূল শহরগুলোকে টার্গেট করে শিল্পোন্নয়নের চেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন এলাকা থেকে শিল্পীদেরকে এনে জড়ো করা হয়েছিল। সরাইখানা এবং বিভিন্ন বাজারঘাটও গড়ে উঠেছিল এইসব শহরকে কেন্দ্র করে। বাজারের ওপর যথার্থ দেখাশোনার ফলে অর্থ ব্যবস্থায় কোনোরকম সমস্যা বা জটিলতা সৃষ্টি হয় নি। বিশ্ব বাজারের সাথে যোগাযোগ খুব বেশি গড়ে না উঠলেও যেটুকুই স্থাপিত হয়েছিল তার ফলে অর্থব্যবস্থা তেমন কোনো উত্থান-পতনের মুখে পড়ে নি। যার পরিণতিতে ইসলামী সমাজের কল্যাণ তুলনামূলকভাবে কম হয় নি।
ইসলামের আবির্ভাবের প্রাথমিক পর্যায়েই দ্বীনী ব্যক্তিত্ব তথা আধ্যাত্মিক মনীষীগণ শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে তাঁদের হাতেই দায়িত্বটি রেখে দিয়েছিলেন। ওসমানী সমাজে পরিবার ব্যবস্থার মধ্যেই শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার প্রাথমিক কাজটি পালনের দায়িত্ব ছিল। এছাড়া প্রত্যেকটি শহরেই এমনকি বলা যায় সকল গ্রামেই স্থাপন করা হয়েছিল শিশু শিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বিখ্যাত স্থপতিদের দিয়ে এ সময় বিখ্যাত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। দারুল কুররা কিংবা দারুস সিবইয়ন নামে পরিচিত ছিল উচ্চ শিক্ষার এইসব প্রতিষ্ঠান। বড়ো বড়ো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাচুর্যের কারণে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছিল বহু বিদ্যান এবং দ্বীনী ব্যক্তিত্ব। সতেরো শতকের সূচনা থেকে ওসমানী এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর মাঝে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যাপক বেড়ে গিয়েছিল। ওসমানী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার পণ্যসামগ্রী ইউরোপীয় দেশগুলোর নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর প্রয়োজন মটাতো। তেল, মাছের তেল, চামড়া, প্রাকৃতিক ঘাস, হালকা অস্ত্র সামগ্রী, সাজগোজের জিনিসপত্রের মতো পণ্য সামগ্রী ইউরোপের যেত এখান থেকেই।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ওসমানী সরকার দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে বিশেষ করে সাফাভিদের সাথে সংঘর্ষের কারণে সেই সতেরো শতকেই আর্থিক সংকটে পড়েছিল। এরই জের ধরে ওসমানীরা ধীরে ধীরে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাথে পরাজিত হতে থাকে। সতেরো শতকের শেষের দিকেই ইউরোপীয় শক্তিগুলোর ক্ষমতা বেড়ে যায় এবং ফ্রান্স, বৃটেন, রাশিয়া ওসমানী হুকুমত থেকে বাদ পড়ে যায়। আঠারো শতক থেকে এই ওসমানী সরকার কার্যত বৃহৎ শক্তিগুলোর কূটনৈতিক হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে যায়।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবু সাঈদ/ ১৩