আগস্ট ০৭, ২০১৮ ১৮:৫৯ Asia/Dhaka
  • দেখব ঘুরে ইরান এবার: অমোল শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন

অমোলের কেন্দ্রিয় শহরটির নামও অমোল। ইরানের প্রাচীন শহরগুলোর একটি এটি। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এবং ভূগোলবিদ এই শহরটিকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের বলে মত দিয়েছেন।

তবে এখানে খননকাজ চালিয়ে যেসব প্রমাণপঞ্জী পাওয়া গেছে বিশেষ করে প্রাচীন মুদ্রা এবং সিলের নমুনা পাওয়া গেছে কিংবা মুসলমান ইতিহাসবিদদের বই পুস্তকে যেসব বর্ণনা রয়েছে তা থেকে অনুমিত হয় যে সাসানী শাসনামলে অমোল শহরটি ছিল তাবারেস্তনের রাজধানী। যাই হোক এই অমোলে রয়েছে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো বহু স্পট এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন। রয়েছে অনেক বন জঙ্গল, ঝর্ণা আর খনিজ পানির উৎস। এখানকার আবহাওয়াও খুবই চমৎকার।

অমোল শহরের দক্ষিণ অংশে রয়েছে আলবোর্য পর্বতমালা। উত্তরে রয়েছে প্রবহমান নদী। হারয নদী। উপকূলীয় বা নদী তীরবর্তী অংশে বিরাজ করে আর্দ্র এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর পার্বত্য অংশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং ঠাণ্ডা। হারয নদীটি অমোল শহরের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যতগুলো নদী আছে সবগুলোর মধ্যে হারয নদীটি বিচিত্র কারণে প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। নদীটি অমোল শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে কাস্পিয়ান সাগরের দিকে। এই শহরের লোকজনের আয়ের প্রধান উৎস হলো কৃষিকাজ। বিশেষ করে ধান, গমসহ বিচিত্র জাতের শাকসব্জিই বেশি উৎপন্ন হয় এখানে। তাছাড়া বাগানে কমলা এবং কমলা জাতীয় ফলগুলো প্রচুর উৎপাদিত হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের ভাষ্যমতে ‘অমর্দ্’ নামে একটি প্রাচীন গোত্র ছিল। তারা খ্রিষ্টপূর্ব কয়েক হাজার বছর আগে তাবারেস্তন-অর্থাৎ বর্তমান মযান্দারনে- এসেছিল। এই গোত্রটি তখন তাবারেস্তনের সবচেয়ে আবাদি এবং উন্নত এলাকাটিকেই বেছে নিয়েছিল বসবাস করার জন্যে। সেই উন্নত এলাকাটিই ছিল এই অমোল। কোনো কোনো গবেষকের মতে অমোল শব্দটি ‘অমর্দ্’ শব্দেরই ভিন্নরূপ বা পরিবর্তিত রূপ। বহুল উচ্চারিত এবং ব্যবহৃত হতে হতে ধীরে ধীরে এই রূপ লাভ করে। অমোল একটি জেলা শহর। এই শহরটির কেন্দ্রিয় শহরের নামও অমোল। যেমনটি শুরুতেই বলেছিলাম।

তো জেলা শহর হবার কারণে সেই প্রাচীন আমলেই যথেষ্ট উন্নত ছিল এবং সেইসাথে ছিল বেশ জনবহুল। উন্নত এবং জাঁকজমকপূর্ণ এই শহরটির ওপর দিয়ে কালক্রমে বয়ে গেছে প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক এবং মানবিক বহু চড়াই উৎরাই। কখনো হারয নদীতে সৃষ্টি প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাস, কখনো ভূমিকম্প আবার কখনো তেমুর গোরকানী কিংবা মোঙ্গলদের হামলার শিকার হয়েছিল শহরটি। এইসব বিচিত্র আক্রমণ ও হামলার কারণে অমোল শহরটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া এই শহরটি পুনর্নির্মাণ করা হলেও এর হারানো শান শওকত আর ফিরে আসে নি, ফিরে আর আসবেও না।

এবারে এখানকার দর্শনীয় নিদর্শনগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া যাক। সমুদ্র উপকূলীয় এই অমোল শহরের চমৎকার আবহাওয়া ছাড়াও এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক বন বনানী এবং খনিজ পানির ধারা। এসবের বাইরেও এখানে রয়েছে ধর্মীয় অনেক স্থাপনা। মির কাউয়াম উদ্দিন মারাশির কবর, ইমামযাদা ইব্রাহিমের মাযার ইত্যাদি এখানকার ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনা। আবার দাভযদাহ চেশমে পুলও এখানকার একটি দেখার মতো প্রাচীন নিদর্শন। আরো রয়েছে প্রাচীন বহু ভবন। ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সারা বছরই প্রায় লোকজন এখানে আসে এগুলো দেখার জন্যে এবং এখানকার চমৎকার আবহাওয়া উপভোগ করার জন্যে।

ইমামযাদে ইব্রাহিম মূলত একটি মাযার। নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় যে ইমামযাদা হলেন নবীজীর বংশধর। এই মাযার ভবনটির ডিজাইন বা স্থাপত্যশৈলী থেকে হিজরি দশম শতকের বলে ইতিহাসবিদগণ ধারণা করেন। মির কাউয়াম উদ্দিন মারাশির কবরটি সাফাভি শাসনামলের অর্থাৎ হিজরি এগারো শতকের বলে মনে করা হয়। এই মাযারটি অবশ্য ‘মাশহাদে মির বোযোর্গ’ নামেই বেশি প্রসিদ্ধ। এই ভবনটির আয়তন, প্রধান দরোজা, টাইলসের চমৎকার কাজ, কাঠের সুদর্শন সিন্দুক মযান্দারনের বিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক স্থাপনার অন্তর্ভুক্ত।

মযান্দারনের কিছু রীতি রেওয়ায আছে একেবারেই অনন্য সাধারণ। এগুলো জাতীয় ঐতিহ্যের মর্যাদা লাভ করেছে এখন। এখানকার আনুষ্ঠানিকতাগুলো অতিথিদেরকেও ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। এরকম একটি অনুষ্ঠান হলো ‘বারফ্‌চল’। হারয মহাসড়কের পাশে অবস্থিত অমোল শহরের লারিজান এলাকায় ‘আস্ক্‌’ নামে একটি গ্রাম আছে। ঐ গ্রামেই মূলত এই ‘বারফচল’ অনুষ্ঠানটি হয়ে থাকে। এই রসমটি খুবই প্রাচীন। ফার্সি উর্দিবেহেশত মাসের প্রথম পণর দিনের কোনো এক জুমা বা শুক্রবারে এই অনুষ্ঠানটি ঘটা করে উদযাপিত হয়ে থাকে। একুশ এপ্রিল থেকে একুশ মে হলো ফার্সি উর্দিবেহেশত মাস। সাধারণত এ এলাকায় শীতকালীন সর্বশেষ বরফ অর্থাৎ যখন তা গলতে শুরু করে তখন এই আয়োজনটি হয়।

অনুষ্ঠানের দিনে গ্রামের সকল পুরুষ মানুষ ভোরে ভোরে বেরিয়ে যাবে। তারা আর ঘরে ফিরে যেতে পারবে না। পুরুষেরা যেহেতু বেরিয়ে যাবে সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই এদিনে গ্রামের সকল কার্যক্রমের ভার পড়ে বাড়ির মহিলাদের ওপর। আর মহিলারা এই সুযোগে মসজিদে অথবা গ্রামের এরকম কোনো গণজমায়েতস্থলে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উদযাপন করবে। যেমন তারা জামাই-বৌ খেলা, রাজা-মন্ত্রী খেলা, পাথর খেলাসহ আরো বহু খেলায় মগ্ন হবে। সেইসাথে স্থানীয় আরো বহু বিনোদন আয়োজনও থাকবে। এদিন গ্রামের ভেতরে কোনো পুরুষ মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কোনো পুরুষ যদি ভুলক্রমেও গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ে তাহলে নারীরা সমবেতভাবে তাকে লাঠিপেটা করে তাড়াবে।

এই ফাঁকে গ্রামের বিতাড়িত কিংবা স্বেচ্ছা নির্বাসিত পুরুষদের কাজ হবে বারফ্‌চলে গিয়ে বরফ কাটা। পাহাড়ের সর্বশেষ বরফ কেটে বিশাল পুকুর ভর্তি করাই হলো তাদের কাজ। আস্ক্‌ গ্রামের অধিবাসীদের বিশ্বাস হলো এই পুকুরটি সাইয়্যেদ হাসান ভালি নামের এক লোক খনন করেছিলেন। তাঁর কবরটি নিয়াক গ্রামে অবস্থিত। ঐ কবরটি গ্রামবাসীদের কাছে খুবই পবিত্র। সবাই এই কবরটি যিয়ারত করে থাকে। তো পুকুরটিতে বরফ ফেলতে ফেলতে যখন পূর্ণ হয়ে যায়, তখন পুরুষেরা সকলে পুকুরের বৃত্তায়িত প্রান্তে দুপুরের খাবার , চা, ফল ফলাদি খায়।

এই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পুরুষেরা নামায পড়ে, দোয়া করে, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে গ্রামে ফিরে যায়। এই আনুষ্ঠানিকতাটি আসলে মুসাফিরদের জন্যে এবং পশুদের খাবারের জন্যে গ্রীষ্মের সঞ্চয় হিসেবে পালন করা হয়। যেহেতু গ্রীষ্মে পানির স্বল্পতা থাকে, সেহেতু এই আয়োজন। বসন্তের সূচনায় বরফ গলে যেন পানি নষ্ট হয়ে যেতে না পারে সেজন্যেই এই ব্যবস্থা। আস্ক গ্রামে এখন অবশ্য পশুপালনের প্রচলন তেমন একটা নেই, তবে অনুষ্ঠান আজো ঠিকই পালন হচ্ছে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/০৭

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন