ইরানে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর (পর্ব-২)
ইরানের ইসলামী বিপ্লব এক নতুন ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি গড়ে তুলছে। এই প্রচেষ্টা যদি সফল হয় তাহলে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তা শোষণ-পীড়ন, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও বলদর্পিতার কবর রচনা করবে। জাতিগুলোর সম্পদ লুণ্ঠন ও শোষণও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের এই মহান আদর্শ ও লক্ষ্যের সঙ্গে পশ্চিমা নির্যাতিত জণগনের কোনো বিরোধ নেই। আর এই একই কারণে ইসলামী ইরান ও ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমা সরকারগুলোর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা সফল হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও বিস্ময়কর নানা সাফল্য প্রমাণ করেছে যে একটি জাতি খালি হাতেই নানা ধরনের বড় পরিবর্তন বা আমূল পরিবর্তনের উৎস হতে পারে এবং এমনকি পরাশক্তিগুলোর নানা পরিকল্পনা ও হিসেব-নিকেশকেও উল্টে দিতে সক্ষম।
প্রখ্যাত ইরানি অধ্যাপক মানুচেহ্র মোহাম্মাদির মতে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের ফলে ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বাত্মক সংঘাত শুরু হয়। ইসলামী ইরান একটি আদর্শিক রাষ্ট্র হিসেবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে তার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে বলে অধ্যাপক মোহাম্মাদি উল্লেখ করেছেন।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের সূচনা-লগ্ন থেকে এই মহান বিপ্লবের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার এ পর্যন্ত অন্তত ১৭টি মহা-ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। এসব মহা-ষড়যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান, পাঁচবার জাতিগত বা গোত্রীয় দ্বন্দ্ব উস্কে দেয়া, ইরানের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দকে হত্যার জন্য চারটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গড়ে তোলা, দু'টি যুদ্ধ ও তিনটি বড় ফিতনা তথা দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানো। কিন্তু এতসব বাধা আর ভয়ানক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে এবং ইরানের ইসলামী সরকার বলদর্পি শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। ইরানের এই মহান বিপ্লবের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধের ফলে এ অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বলদর্পি শক্তিগুলোর পাকানো ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের সব পর্বই একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে।
জনগণ ও নেতৃবৃন্দের বিস্ময়কর ঐক্য এবং লক্ষ্যের অভিন্নতা ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার অন্যতম প্রধান রহস্য।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সফল স্থপতি মরহুম ইমাম খোমেনী এই বিপ্লবে ইরানি জাতির ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেছিলেন: 'ইরানের মুসলিম জাতি সমস্ত শক্তি নিয়ে ইসলামের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং তারা এক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ জাগরণের মাধ্যমে ইসলামের শত্রু শাহ সরকারকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ইরানি জাতি ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাসের কারণে এ ধর্মের সুরক্ষায় সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তাই ইরানি জাতির এই সংগ্রাম যে বিজয় অর্জন করবে ও শত্রুরা পরাজিত হবে তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।'
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী একই প্রসঙ্গে বলেছেন: যে কোনো বিপ্লবকে সফল করতে হলে একটি চিন্তাগত চালিকা-শক্তি ও দু'টি মানবীয় চলকের দরকার হয়। চিন্তাগত দিকটি হল বিপ্লবের সুমহান আদর্শ। আর মানবীয় দুই চলক হল জনগণ ও নেতৃবৃন্দ। আর এই তিন চালিকা-শক্তি যখন অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ায় তখনই ঘটে যায় বিপ্লব।
ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতার মতে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের আরেকটি বড় রহস্য ছিল এই বিপ্লবের স্থপতি মহান ইমাম খোমেনী (র)'র যথাযোগ্য নেতৃত্ব। একজন সফল ধর্মীয় নেতার যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার ছিল তার সবই ছিল এই মহান ইমামের মধ্যে। গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা ছিল ঐশী নেতা বা ইমামের কাছাকাছি পর্যায়ের।
প্রখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো ইরানের ইসলামী বিপ্লব পরিদর্শনে এসেছিলেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এবং জনগণের ঐক্য ও সংহতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি তাঁর 'নিষ্প্রাণ বিশ্বের প্রাণ ইসলামী বিপ্লব' নামক গ্রন্থে লিখেছেন-"বাস্তবতা হল এই বিপ্লবী ঘটনার উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। কারণ এই বিপ্লবে পুরো একটি জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।" তিনি আরও বলেছেন, "আধ্যাত্মিকতা ছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মূলভিত্তি। এ বিপ্লব পুরনো চিন্তাধারার প্রতি ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে। এ বিশেষত্ব ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে এবং নিজেই একটি আদর্শে পরিণত হয়েছে।"
ফুকো মরহুম ইমাম খোমেনীর যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন: আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ব্যক্তিত্ব কিংবদন্তীতুল্য ও ক্যারিজমাটিক এবং অন্য কোনো বিপ্লবেই এমন নেতা দেখা যায় না। কারণ, জনগণের সঙ্গে তাঁর রয়েছে গভীর ঘনিষ্ঠতার বন্ধন। কোনো সরকার-প্রধান বা রাজনৈতিক নেতাই দুনিয়ার সব গণমাধ্যমের সমর্থন নিয়েও ইমাম খোমেনীর অবস্থান বা মর্যাদার সমতুল্য অবস্থার দাবি করতে পারবেন না। ফুকো ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে "প্রথম অত্যাধুনিক বিপ্লব" ও "গণজাগরণের আধুনিকতম রূপ" বলেও মন্তব্য করেছেন। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১