ইরানে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর (পর্ব-৩)
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ঘটা ছিল যেমন এক অবিশ্বাস্য বা অলৌকিক বিজয়ের সমতুল্য তেমনি এ বিপ্লবের আজও তথা ৪০ বছর ধরে টিকে থাকাটাও এক মহা-বিস্ময়কর ঘটনা।
একজন মহান আলেমের নেতৃত্বে বস্তুতান্ত্রিক এই আধুনিক যুগে যে একটি ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা টিকে থাকবে তা ছিল কল্পনাতীত। ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (র)'র সুযোগ্য নেতৃত্ব ছিল এ বিপ্লবের অলৌকিক সাফল্যের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। তাঁর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তার ভিত্তি ছিল খোদাভীতি। মহানবী (সা) ও পবিত্র আহলে বাইতের একনিষ্ঠ অনুসারী এই মহান আলেম ও নেতার জীবন ছিল পবিত্র কুরআন এবং মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার যথাসাধ্য ও আন্তরিক অনুসরণের বরকতে গড়ে-ওঠা। তাই পশ্চিম-এশিয়ায় ইহুদিবাদী ইসরাইল ও মার্কিন সরকারের প্রধান সহযোগী স্বৈরতান্ত্রিক শাহ-সরকারের নানা জুলুমের বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ হওয়ার দায়ে ১৯৬৩ সনের ৫ জুন নির্ভিক এই আলেমকে যখন সরকারি নির্দেশে কোম শহরে গ্রেফতার করা হয় তখন ইরানের জনগণ তার মুক্তির দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ সময়ে জনগণের শ্লোগান ছিল হয় খোমেনী, না হয় মৃত্যু!
অত্যন্ত উচ্চস্তরের ইসলামী আইনবিদ ও ফকিহ এবং খোদাভীরু ব্যক্তিত্ব ছিলেন বলেই আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা মুসাভি খোমেনি ইমাম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ইমাম খোমেনী যখন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ও গোটা জাতির অবিসম্বাদিত রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ফ্রান্সের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ৭৯ বছর বয়সে ইরানে প্রবেশ করেন তখন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তেহরানে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ৬০ লাখ ইরানি। অন্যদিকে দশ বছর ধরে সফল কাণ্ডারির মত ইসলামী বিপ্লবের মহা-কিশতিকে পরিচালনার পর তিনি যখন ৮৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন তখন তাকে শেষ বিদায় জানানোর জন্য তেহরানে অন্তত এক কোটি ইরানির সমাবেশ ঘটে। অর্থাৎ সে সময়ও তিনি ইরানের অবিসম্বাদিত রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে মুসলিম বিশ্বে ইমাম খোমেনী ছাড়া অন্য কোনো আলেম নেতার উত্থানের দৃষ্টান্ত নেই যিনি পরাশক্তিগুলোর কোনো তোয়াক্কা না করে ও বিশেষ করে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি মার্কিন সরকারের গালে চপেটাঘাত হেনে গোটা বিশ্বকে অভিভূত করতে সক্ষম হয়েছেন!
ইমাম খোমেনী (র)'র নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার পর টাইম ম্যাগাজিন পশ্চিমা বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, গোটা মুসলিম উম্মাহ জেগে উঠছে! তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প!

রুশ লেখক নিকোলা মিশিন ইমাম খোমেনী (রহ) সম্পর্কে লেখা তাঁর বইতে লিখেছেন,‘ইরানের ইসলামী বিপ্লব মানুষের অন্তর কেড়ে নিয়েছে। ইমাম খোমেনী (রহ) মার্কিন ও বিশ্বসাম্রাজ্যবাদকে উপেক্ষা করে বলেছেন-আমাদের নিজস্ব মূল্যবোধ হলো কুরআনের মূল্যবোধ এবং পশ্চিমা গণতন্ত্রের চেয়ে ইসলামী গণতন্ত্র অনেক বেশি পরিপূর্ণ। বিশ্বে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হলো আলকুরআন। এই কুরআন যার সাথে থাকে সে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ।’
আসলে বস্তুতন্ত্রের নাগপাশে আবদ্ধ পৃথিবীতে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ঔজ্জ্বল্য ছিল মুজিজার মতই মহা-বিস্ময়কর। তাই ইমাম খোমেনী (রহ) বিপ্লব বিজয়ের ঘটনাকে মোজেযা বা খোদায়ী নিদর্শনের প্রকাশ বলে অভিহিত করে বলেছেন-সমাজে একটা আত্মিক পরিবর্তন এসেছে।
ইসলামী ইরানকে মহান ইসলামের বৈপ্লবিক আদর্শ ও আপোষহীন নীতিমালা থেকে বিচ্যুত করতে এত বিপুল সংখ্যক ষড়যন্ত্র, অবরোধ, যুদ্ধ ও সংঘাতের মত বিচিত্রময় বাধা চাপিয়ে দেয়া হয় যে সাধারণ কোনো দেশ বা জাতি হলে এক মাস বা বড় জোর কয়েক মাসের বেশি বিপ্লবী আদর্শের ওপর অবিচল থাকতে পারত না। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকারের ইশারায় বিপ্লবের প্রায় এক বছর পরই ইসলামী বিপ্লবী ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সাদ্দামের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ। সে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সাদ্দামকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছিল বিশ্বের সবগুলো পরাশক্তিসহ অন্তত ৩৫টি দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইসলামী ইরানই এ যুদ্ধে বেশি সাফল্য ও বিজয় অর্জন করে।
ইসলামী বিপ্লবের পরপরই মার্কিন সরকারের মত প্রবল পরাক্রান্ত দাম্ভিক শক্তির ৫২ জন কূটনীতিককে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে ইরানি দূতাবাসে ৪৪৪ দিন আটকে রেখেছিল ইরানের বিপ্লবী ছাত্ররা। কূটনীতিকের বেশধারী এইসব গুপ্তচরকে মুক্ত করার জন্য মার্কিন সরকার গভীর রাতের আঁধারে কয়েকটি সামরিক বিমান ও হেলিক্প্টার নিয়ে অভিযান চালাতে গিয়ে অলৌকিক ধুলি-ঝড়ের শিকার হয় এবং কয়েকটি বিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংস হওয়ায় এই অভিযান মার্কিন সরকারের জন্য মহা-বিপর্যয়ে পরিণত হয়। এই ঘটনা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের জন্য খোদায়ি অলৌকিক-সহায়তা ও ইসলামের আধ্যাত্মিক শক্তির নিদর্শন হিসেবে পরাশক্তিগুলোকে হতভম্ব করে দেয়।
ইসলামী বিপ্লবের পর শিক্ষা, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতেও ইরানের চোখ-ধাঁধানো নানা অগ্রগতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ঘুম হারাম করে দেয়। বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ পরমাণু-প্রযুক্তি, ন্যানো প্রযুক্তি, ক্ষেপণাস্ত্র আর মহাকাশ প্রযুক্তি, উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ও চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প এবং অর্থনীতির নানা খাতসহ উন্নয়নের বহু খাতে ইরানের অসাধারণ অগ্রগতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর হিংসা ও ক্ষোভের আগুনকে দিনকে দিন বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে দিশাহারা করে তুলেছে! আর এসবই সম্ভব হয়েছে ইরানের ইসলামী সরকার ও জনগণের দৃঢ়-আত্মবিশ্বাস এবং মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাসের বরকতে। অন্য কথায় ইরানের এসব সাফল্যকেও আধুনিক যুগে ইসলামেরই বিস্ময়কর অবদান বা মোজেজা বলা যায়।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/৩