ইরানে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর (পর্ব-৫)
ইরানে সফল-হওয়া ইসলামী বিপ্লব বিশ্ব-ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনীকে দেখা হয় এক অলৌকিক বিপ্লবী হিসেবে। এ বিপ্লব মুসলিম বিশ্বে ইসলামী জাগরণের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ইসলাম সম্পর্কে পাশ্চাত্যের নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী মহলকে নতুন করে ইতিহাসের পুনর্লিখন ও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী বিপ্লবের পর ইসলামের রাষ্ট্র-দর্শন ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা বিষয়ক পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার ধারায় ইমাম খোমেনীর রাজনৈতিক দর্শনও ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে। ইসলামী পুনর্জাগরণবাদের সবচেয়ে সংগ্রামী ধারার উৎস ও প্যান ইসলামীজম বা ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের স্বরূপকে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চিন্তা-চেতনার আলোকে বিশ্লেষণ করতে বাধ্য হচ্ছেন গবেষকরা। কিভাবে ইসলামী বিপ্লব ৪০ বছর পরেও টিকে থাকছে তা নিয়েও গবেষণা ও কৌতূহলের অন্ত নেই রাষ্ট্র-বিজ্ঞান, সমাজ, ইতিহাস, দর্শন ও ধর্ম সংক্রান্ত গবেষক ও বিশ্লেষক মহলে।
ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বাধীন ইরানের ইসলামী বিপ্লব এমনই এক আলোকোজ্জ্বল বা নুরানি বিপ্লব যে 'ধর্মের ঢোল আপনিই বাজে' –এমন প্রবাদ বাক্যের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত হয়ে এ বিপ্লবের বাণী দেশে দেশে মুক্তিকামী জাতিগুলোর অন্তরের অন্তঃস্থলে ঠাঁই করে নিচ্ছে। আলোর এক সর্বব্যাপী বন্যা বা মহাবিস্ফোরণের মতই তা খাঁটি মুহাম্মাদি ইসলামের সৌরভকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আধুনিক যুগেও সংগ্রামী ইসলাম যে মানব-রচিত মতবাদগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ গড়ে তুলতে সক্ষম ইরানের ইসলামী বিপ্লব তারই প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দেখা দিয়েছে।
সংগ্রামী মুসলিম আলেম, চিন্তাবিদ ও রাজনীতিবিদদের কাছে ইরানের ইসলামী বিপ্লব যেন ইসলামী সভ্যতার গৌরবময় পতাকা পুনরোত্তলনের সেই অকৃত্রিম আহ্বানেরই প্রতিধ্বনি যার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল হেরা-প্রান্তরে এবং যা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল শত শত বছর ধরে কারবালা ও ক্রুসেডসহ সংগ্রামের নানা ময়দানে। তাই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের রহস্য নিয়ে যুগ যুগ ধরে আলোচনা ও গবেষণা চলতেই থাকবে। কোম থেকে এক বড় নেতার উত্থান হবে এবং তিনি মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান জানাবেন-এ জাতীয় বর্ণনা বা হাদিসও স্মরণ করিয়ে দেয় ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনীর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের অসাধারণ উচ্চতাকে!
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী ছিলেন মহানবীরই বংশধর। তাঁর জন্ম হয়েছিল নবী-নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমার জন্ম দিনে! বাবাও ছিলেন একজন প্রখ্যাত সংগ্রামী শহীদ আলেম। খুব কম বয়সেই তিনি উচ্চ পর্যায়ের ইসলামী আইনবিদ বা ফকিহ এবং শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ও মর্যাদা অর্জন করেন। আত্মিক পরিশুদ্ধি ও কুরআনের তাফসির বিষয়ক তার আলোচনা শুনলেই বোঝা যায় তিনি কত উচ্চ পর্যায়ের গবেষক, দার্শনিক ও বিশ্লেষক ছিলেন। তার আধ্যাত্মিক প্রভাব সম্পর্কে আহমদ দিদাতের মত খ্যাতনামা ইসলাম-প্রচারক বলেছেন যে, ইমাম খোমেনীকে দেখামাত্রই আপনাদের চোখে পানি চলে আসবে! আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তার সুন্নাতি চালচলন, পোশাক ও নুরানি অভিব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। তিনি যখন খুব সাদামাটাভাবেও ইসলামী সম্পর্কে বক্তব্য রাখতেন তখনও উপস্থিত শ্রোতারা কেঁদে উঠতেন!
অন্যদিকে ইসলামের শত্রুদের সম্পর্কে ইমাম খোমেনী (র) ছিলেন তার পূর্বপুরুষ মহানবীর (সা) অনুসারী এবং অবিচল পাহাড়ের মতই আপোষহীন ও অনমনীয়। আর সে জন্যই তিনি দৃঢ়চিত্তে বলতেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোর মতবাদ নয় বরং ইসলামই শ্রেষ্ঠ। তিনি একদিকে যেমন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে চরম ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন তেমনি তিনি মোটেও আপোষ করেননি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গেও। বড় শয়তান আমেরিকার সঙ্গে সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনেরও বিরোধিতা করেছেন। সমাজতন্ত্র যে কেবল জাদুঘরে ঠাঁই পাবে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও তিনি করে গেছেন নিখুঁতভাবে!
জুলুম, শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধ চরম বিদ্রোহ আর আপোষহীনতার কারণেই ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর বিপ্লবী এ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয় মার্কিন সরকার। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার ইহুদিবাদী ইসরাইলের দূতাবাস বন্ধ করে দিয়ে ইরানে ইসলামী বিপ্লবী সরকার তেহরানস্থ সেই দূতাবাসটিকে ফিলিস্তিনের দূতাবাসে পরিণত করে!
উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো পাশ্চাত্যের 'বৈশ্বিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে প্রথম বড় ধরনের অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের এ সম্পর্কিত এক নিবন্ধে ইতিহাস গবেষক আলতাফ পারভেজ লিখেছেন, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব ও গণচীনের বিপ্লবের পর ইরানের রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল গত শতাব্দীর বড় এক তাৎপর্যবহ ঘটনা। মস্কোতে কমিউনিস্টরা ২৮ বছর আগে ক্ষমতা থেকে অপসারিত। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি থাকলেও সমাজতন্ত্র আর নেই। কিন্তু ইরানে আয়াতুল্লাহরা টিকে আছেন।.... ইরানে আয়াতুল্লাহরা ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সাধারণভাবে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি কিংবা ভোগবিলাসে মত্ত হননি। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা নিজেদের জন্য সুযোগ-সুবিধার আলাদা জগৎ তৈরি করেননি।
গবেষক আলতাফ পারভেজ আরও লিখেছেন, ইরান-বিপ্লব নিয়ে ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকোর উচ্ছ্বাস তখনকার বামপন্থী জগতে বিশাল বিস্ময় ছিল। ফুকো ‘মৌলবাদ’ বা ‘ইসলামি’ তকমায় না ফেলে ‘অন্তহীন ইতিহাসের এক বর্তমান প্রকাশ’ হিসেবে ইরানকে বুঝতে চাইছিলেন। খোমেনির ‘আধ্যাত্মিকতার রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ফুকো আশাবাদী ছিলেন। নতুন রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই ‘নবতরঙ্গ’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দিগন্ত পাল্টে দেবে বলে তিনি মনে করতেন। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের পরিস্থিতি হয়তো তাঁর অনুমানের সাক্ষ্য এখন।
আলতাফ পারভেজ আরও লিখেছেন, ইরানের এই বিপ্লব পশ্চিমা উদারতন্ত্রের বিপক্ষে মোল্লাতন্ত্রের অভ্যুত্থানের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। রাজনীতি, দল ও ধর্ম—এই তিন প্রত্যয় পশ্চিমে পৃথক হলেও ইরানের মতাদর্শে তা ঠিক উল্টো বলে এই লেখক মন্তব্য করেন। আর এ কারণেই নেতা হিসেবে রুহুল্লাহ খোমেনির উত্থান ও মৃত্যুর ৩০ বছর পরও তাঁর বিপ্লব টিকে যাওয়ার অনেক কার্যকারণই বাকি দুনিয়া আজও বুঝতে অক্ষম বলে আলতাফ পারভেজ মত প্রকাশ করেন।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/৬