ইরানে দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর (পর্ব-৯)
ইরানে ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লব বিশ্ব-ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে বলে বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পশ্চিম এশিয়ায় এই বিপ্লব সৃষ্টি করেছে ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের এক শক্তিশালী ও সফল ধারা যাতে যুক্ত হয়েছে লেবানন, ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও ইয়েমেনের সংগ্রামী জনগণ এবং সরকার। এ বিপ্লব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে থাকা ফিলিস্তিনকে আবারও অনেকাংশে সম্মানজনক অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছে। ইসলামী বিপ্লব লেবানন ও সিরিয়াকেও রক্ষা করেছে ইসরাইলের দানবীয় গলধঃকরণ থেকে। ইহুদিবাদী ইসরাইল নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত ইসরাইলকে বিস্তৃত করার যে আশা পোষণ করত ও প্রকাশ্যে তা উল্লেখ করত তা আজ কেবলই দূরাশা, বরং ইসরাইল এখন তার অস্তিত্বকে বিপন্ন বলে গভীর শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। অথচ ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও এর প্রভাবকে দুর্বল এবং ধ্বংস করার জন্য এমন কোনো প্রচেষ্টা নেই যার আশ্রয় নেয়নি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদী মহল।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের এতসব বড় সাফল্যের প্রেক্ষাপটে এ মহান বিপ্লবের গৌরবময় বিজয়ের ৪০ তম বার্ষিকী পালনের জন্য ব্যাপক আলোচনা ও উৎসব সমাবেশের আয়োজন করা উচিত এবং বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ ও মুসলমানদের বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়ার জাতিগুলোর উচিত এ ধরনের উৎসব সমাবেশে যোগ দেয়া।
বিগত ৭০ বছর ধরে মার্কিন সরকার মধ্যপ্রাচ্যে তথা পশ্চিমা এশিয়া ও তার আশপাশে বহু ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে যে প্রভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লব গত ৪০ বছরে তা প্রায় পুরোপুরি বরবাদ করে দিয়েছে। ফলে মার্কিন শাসকরা ইরাক ও আফগানিস্তানের মত দেশে সফর করছেন গোপনে! এ যেন ভীত-সন্ত্রস্ত চোরদের গোপন আসা-যাওয়া! খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে এ অঞ্চলে মার্কিন সরকার ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও কোনো সাফল্য পায়নি। উল্লেখ এক হাজার বিলিয়নে হয় এক ট্রিলিয়ন এবং এক বিলিয়ন অর্থ ১০০ কোটি।

অতীতের সব মার্কিন শাসকের মত বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইরানের ইসলামী সরকারের প্রতি অন্তহীন বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করেন। ক্যাসিনোর মত নোংরা ব্যবসায়ে জড়িত ট্রাম্প ১৯৭৮ সালে ইরানে এসেছিলেন উত্তর তেহরানে একটি ক্যাসিনো খোলার পরিকল্পনা নিয়ে। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ায় জুয়ার আস্তানা বসানোর সেই পরিকল্পনা কখনও সফল হয়নি। ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া ট্রাম্প যেন সেই দুঃখকে শতগুণ বিদ্বেষ নিয়ে লালন করছেন! ট্রাম্প বলেছিলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব ৪০ তম বর্ষে উপনীত হতে পারবে না। কিন্তু বিশ্ব এখন সবিস্ময়ে দেখছে যে ইরানে ইসলামী বিপ্লব ৪০ বছর পর আজও সমহিমায় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে টিকে আছে! এ বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী আজ বিশ্বের কোটি কোটি জনগণ ও মুসলমানের হৃদয়ে রাজত্ব করে যাচ্ছেন। অন্যদিকে ইরান-বিরোধী মার্কিন শাসকদের কেউ কেউ কবরস্থ হয়ে কেবল পোকা ও কিটের খাবার হয়ে ইতিহাসের ডাস্টবিনে পড়ে বিস্মৃত হচ্ছেন এবং ট্রাম্পের মত শাসকরাও ঘৃণ্য শাসক হিসেবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে একের পর এক নানা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সরকার সম্প্রতি পোলান্ডে ইরান বিরোধী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। কিন্তু আরব দেশগুলোকে নিয়ে ইরান-বিরোধী ন্যাটো জোট গঠনের পরিকল্পনার মতই এ সম্মেলনও ব্যর্থ হবে বলে পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন যার নানা লক্ষণ ও আভাস এরি মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবোত্তর ইসলামী জাগরণের সংগ্রামী প্রকৃতি ও অগ্রগতি লক্ষ্য করেই ১৯৯৩ সনে মার্কিন চিন্তাবিদ স্যামুয়েল হান্টিংটন সভ্যতার মধ্যে দ্বন্দ্বের তত্ত্ব রচনা করেন। ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে যাতে কোনো আদর্শিক ঐক্য হতে না পারে এবং সংগ্রামী ইসলাম যাতে পুঁজিবাদের জন্য চ্যালেঞ্জ না হয় তা এই তত্ত্বের অন্যতম লক্ষ্য।
হান্টিংটনের এই তত্ত্বের আলোকেই ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে রহস্যময় হামলার ঘটনাকে অজুহাতে করে মার্কিন সরকার ইরাক ও আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছিল। অথচ এটা স্পষ্ট যে ১১ সেপ্টেম্বরের ওই হামলা ছিল আসলে মার্কিন-ইহুদিবাদী এক মহাষড়যন্ত্রেরই ফসল। আর তাই দেখা গেছে ওই হামলার পরপরই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ ক্রুসেডের আহ্বান জানাতে দ্বিধা বোধ করেননি। ইহুদিবাদী উগ্র খ্রিস্টানদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন মার্কিন রিপাবলিকান দলের যোগসাজশ তাদের ইসলাম-বিদ্বেষকে স্পষ্ট করে দেয়।
ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের অন্তহীন সংগ্রাম ইসলামকে দুর্বল না করে দিনকে দিন জোরদার করছে। মুক্তিকামী বিশ্ববাসী ও জাতিগুলো মনে করে দেশে দেশে ইসলামী গণ-জাগরণ ও ইসলামী বিপ্লবী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার প্রচলনই মানুষকে সব ধরনের শোষণ, অন্যায় ও দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারে। আর তাই ইরানের ইসলামী বিপ্লব তাদের জন্য এক সফল অভিজ্ঞতা এবং আদর্শ যা বৃহত্তর ইসলামী সভ্যতার পুনরুত্থান ঘটিয়ে ইমাম মাহদির নেতৃত্বাধীন বিশ্ব-ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারে।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/ ১০