আগস্ট ০৯, ২০১৯ ২০:০৬ Asia/Dhaka

মানুষের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে অন্যান্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি শলা-পরামর্শও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এ কারণে পবিত্র ইসলাম ধর্মেও পরামর্শ করার ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরামর্শের ভিত্তিতে কোনো কাজ করা হলে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব কাজ সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ হয়। পরামর্শ করে কাজ করলে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও পরামর্শ করে কাজ করতেন। কাজেই আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব ও অহঙ্কার পরিহার করে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করা ইসলামেরই শিক্ষা। তবে অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, পরামর্শ না করেওতো উন্নতি-অগ্রগতি লাভ করা যায়। আপাত দৃষ্টিতে এ ধরণের বক্তব্যকে হয়তো পুরোপুরি অস্বীকার করা যাবে না, তবে এটা নিশ্চিত যে, পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করলে ফলাফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। 

ইসলাম বরাবরই পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করাকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখে আসছে। পবিত্র কুরআনের সূরা আশ-শূরার ৩৮ নম্বর আয়াতে, যারা উত্তম প্রতিদান পাবেন তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, 'এবং যারা তাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দেয়, নামায প্রতিষ্ঠা করে, পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।'

এই আয়াত থেকে বোঝা যাচ্ছে, মুমিন বা বিশ্বাসী মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা যেকোনো কাজ করার আগে পরামর্শ করে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম, মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বৈরাচারি মনোভাব থেকে বেরিয়ে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতে বলেছে। এর ফলে মানুষ যেমন উত্তম ফল পায় তেমনি পারস্পরিক সমঝোতা ও ঐক্যও জোরদার হয়। 

মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) পরামর্শের গুরুত্ব তুলে ধরে হজরত আলী (আ.)-কে বলেছেন, "হে আলী, কাজের ক্ষেত্রে পরামর্শের চেয়ে নিরাপদ অবলম্বন আর কিছু নেই।" আসলে এরপরও আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নিরাপদ অবলম্বনকে পাশ কাটিয়ে যাই। পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায় আমরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি অথবা কাজ সম্পন্ন করে অন্যদের জানাই। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরিবারের সদস্যরা হচ্ছে সবচেয়ে কাছের মানুষ। সাধারণত তারা সব সময় পরস্পরের জন্য সবচেয়ে ভালো পরিণতিটাই কামনা করে। এ কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতে হবে। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) তার মেয়ে হজরত ফাতিমা (সা. আ.)-কে বিয়ে দেওয়ার পর প্রশ্ন করেছিলেন- হে আলী, তোমার জীবনসঙ্গী কেমন হলো? উত্তরে আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) বলেছিলেন, যাহরা হচ্ছে সর্বোত্তম জীবনসঙ্গী যার সহযোগিতায় আল্লাহর প্রতি অনুগত থাকা যায়। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, আলী (আ.) হজরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-কে না জানিয়ে কোনো কাজ করতেন না। নবীকন্যার সঙ্গে পরামর্শ করতেন এমনকি কখনো কখনো তিনি অন্যের সামনে নবীকন্যার বক্তব্যকে যুক্তি ও প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে কথা বলতেন।

পরামর্শ করে কাজ করলে জটিল সমস্যাপূর্ণ বিষয়েরও সহজ সমাধান পাওয়া যায়। এতে ভুল কম হয়। কাজ সুচারু ও সুনিপুণ হয়। মানুষের মধ্যে দলাদলির সৃষ্টি হয় না। কাজ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হয় না। পরামর্শ নিয়ে কাজ করলে আরেকটি লাভ হয় তাহলো, যে ব্যক্তি পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে তাকে লজ্জিত হতে হয় না, কারণ ওই কাজের পেছনে আরও কয়েক জনের সমর্থন ও মত থাকে। পরামর্শ ভিত্তিক কাজে ব্যর্থতা আসলে তাতে অন্যের সহানুভূতি পাওয়া যা। যে ব্যক্তি পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে তার জন্য ওই পরামর্শ এক ধরণের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। অবশ্য সব মানুষই পরামর্শ দেওয়ার যোগ্য নন। অনেকে কুপরামর্শও দিতে পারেন। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পরামর্শ করার অর্থ হলো, এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা, যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের স্পর্শকাতরতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বোঝে এবং যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোনো রোগ ও চিকিৎসার ব্যাপারে পরামর্শ করার প্রয়োজন হলে ডাক্তার ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করাই শ্রেয়।

বর্তমান সমাজে এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না যার কোনো পরামর্শের দরকার নেই। তবে সাধারণত মানুষের মধ্যে অন্যের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়ে অনীহা দেখা যায়। সাধারণভাবে বহু পথ ও উপায় থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু অন্যের সঙ্গে কথা বললে সেগুলো সহজেই চোখে পড়ে। আমরা অনেক সময় বিভিন্ন কারণে পরামর্শ করি না। এসবের একটি হলো আত্মম্ভরিতা অর্থাৎ আমিই সবার চেয়ে বেশি বুঝি। এছাড়া অন্যের ওপর আস্থার অভাবের কারণেও আমরা পরামর্শ করতে চাই না। তবে মনে রাখতে হবে, ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্যের জন্য আত্মম্ভরিতা পরিহার করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।  

পরামর্শের গুরুত্ব সম্পর্কে হজরত সুলাইমান (আ.)'র সময়কার একটি ঘটনা বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। একদিন হজরত জিব্রাইল (আ.) হজরত সুলাইমান (আ.)'র কাছে একটি পাত্র দিয়ে বললেন এই পাত্রে এমন এক পানীয় আছে যা পান করলে আপনি কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবেন। তবে আপনি এই পানীয় পান করবেন কিনা তা পুরোপুরি আপনার ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে। এরপর হজরত সুলাইমান (আ.) মানুষ, জ্বীন এবং অন্য জীবজন্তুর পরামর্শ চাইলেন। সবাই নবীকে ওই পানীয় পান করে কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার পরামর্শ দিলো। এরপর সুলাইমান নবীর মনে হলো একটি প্রাণীর সঙ্গে এখনও পরামর্শ করা হয় নি। আর সেই প্রাণীটি হলো সজারু। এরপরকে সজারুকে ডাকা হলো। সজারুকে ঘটনা খুলে বলার পর পরামর্শ চাওয়া হলো।

সব শুনে সজারু বললো- এই পানীয় কি শুধু আপনার জন্য নাকি আপনার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও বন্ধুরাও তা খেয়ে কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারবে?

উত্তরে হজরত সুলাইমান বললেন- না শুধু আমাকে এই পানীয় দেওয়া হবে।

এই কথা শুনে সজারু বললো, তাহলে তা ফিরিয়ে দেন। খাওয়ার দরকার নেই।

সুলাইমান (আ.) সজারুকে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কেন চিরঞ্জীব হতে নিষেধ করছো? সজারু বললো- যেহেতু কেবল আপনার জীবনটাই দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেকারণে আপনার স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সুহৃদ সবাই মারা যাবে। আপনাকে সারা জীবন তাদেরকে হারানোর দুঃখ-বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তাদেরকে ছাড়া এই জীবনের কী মূল্য আছে?

এসব শুনে হজরত সুলাইমান(আ.) কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন এবং ওই পানীয় আর পান করলেন না।

আসলেই আমাদের এমন জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে যেখানে দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। তবে এমন জীবন কেবল বেহেশতেই সম্ভব। পরকালে সেই চীরস্থায়ী সুখী জীবনের অধিকারী হতে হলে আমাদেরকে এই পৃথিবীর জীবনকে সুন্দরভাবে যাপন করতে হবে। এই পৃথিবীতে যা কিছু পেয়েছি তাকে সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগিয়ে সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে হবে। আর তাহলেই আমরা পরকালেও সুখী হতে পারব। সবাই সুখী হোন এই দোয়ার মধ্যদিয়ে শেষ করছি আজকের আসর।# 

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।