সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯ ২৩:৩১ Asia/Dhaka

সৌদি আরবের জাতীয় তেল স্থাপনা আরামকোতে হুথিদের ড্রোন হামলার পর আমেরিকা আসলে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর অজুহাত খুঁজছে। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান।

তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সামগ্রিক বিবেচনায় ইরানের শক্তি সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া আমেরিকা বর্তমানে সবক্ষেত্রে আগের অবস্থায় নেই। সে কারণে ইরানে সামরিক হামলা চালানোর ব্যাপারটি হবে আমেরিকার জন্য জুয়া খেলা। তবে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবসহ তাদের মিত্রদের দিয়ে প্রক্সিওয়ার চালাতে পারে। কিন্তু তা হবে আমেরিকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেস ইরানে সামরিক হামলার বিষয়টি অনুমোদন দেবে বলে তিনি মনে করেন না।

বিশিষ্ট এ সাংবাদিক বলেন, আমেরিকার অবস্থা আসলে প্যারাডক্স। আর সৌদি আরব ইয়েমেনে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। বর্বর এ যুদ্ধের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন তিনি।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান:  জনাব খন্দকার মুনীরুজ্জামান, সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনার উপর ইয়েমেনের হুথি সমর্থিত সেনারা গত ১৪ সেপ্টেম্বর ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আমেরিকা অভিযোগ করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান হামলা চালিয়েছে তবে সৌদি আরব এখনো পরিষ্কার করে কিছু বলে নি। ইরান অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন প্রশ্ন হচ্ছে- তদন্ত হওয়ার আগেই আমেরিকার এই যে অভিযোগ তাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

আরামকোতে হুথি সমর্থিত সেনাদের ড্রোন হামলা

খন্দকার মুনীরুজ্জামান: দেখুন, আসলে আমেরিকা ও ইসরাইল বহুদিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করছে, অজুহাত খুঁজছে বা অজুহাত বের করার চেষ্টা করছে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর। কোনো না কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ারও চেষ্টা করছে। আর এই সৌদি আরবের জাতীয় তেল কোম্পানিতে ইয়েমেনের ড্রোন হামলার অজুহাতে ইরানের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলছে সেটাই তাদের অজুহাতের এই মুহূর্তের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।

দেখুন, আরামকোতে ইয়েমেনের ড্রোন হামলা নিয়ে এখনও সৌদি আরব পরিষ্কার করে কিছু বলে নি। সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নি। আমরা যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাকে আমেরিকার সরকারিভাষ্য হিসেবে ধরি-তাহলে বলা যাবে আমেরিকা সরকারিভাবে এ অভিযোগ করছে। আর যদি ট্রাম্পেরভাষ্য আমেরিকার সরকারিভাষ্য না হয় অর্থাৎ দেশটির সিনেট বা কংগ্রেসের কোনো বক্তব্য না থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে ট্রাম্প ড্রোন হামলার ভিকটিম সৌদি আরবকে বাইপাস করে এ অভিযোগটি তুলছে ইরানের ওপর হামলা করার উদ্দেশ্যে। তাছাড়া আমরা জানি অতীতে ইসরাইলও বহুবার চেষ্টা করেছে আমেরিকাকে দিয়ে ইরানে হামলা চালানোর।

এখানে  ট্রাম্পের একটি বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়; সেটি হচ্ছে, ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে আমরা জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে আছি।

আমরা যদি একটু অতীতে ফিরে যাই তাহলে দেখব, এএমডি আছে এমন মিথ্যা অভিযোগে ইরাকের বিরুদ্ধে মিথ্যা হামলা করার সময় এবং হামলাকে বিশ্বদৃষ্টির কাছে বৈধ করার জন্য একটা চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে জাতিসংঘের কাছ থেকে নামকাওয়াস্তে অনুমোদন নিয়েছিল। তারপর ইরাকের পরিণতি কী হয়েছিল আমরা সবাই জানি। এখনও ঠিক একইভাবে অর্থাৎ ইরাকের মতো করে-সৌদি আরবের তেল কোম্পানিতে ড্রোন হামলার অজুহাতে জাতিসংঘের একটি অনুমোদন পাওয়া যায় তাহলে তারা ইসরাইলকে সাথে নিয়ে ইরানের ওপর হামলা করতে পারবে। এটি একটি বিষয়।

অন্যটি হচ্ছে-ইরানের ওপর আসলে নতুনভাবে হামলা করার একটা অজুহাত খুঁজছে আমেরিকা।

ইয়েমেনের হুথিদের ড্রোন

রেডিও তেহরান: আপনি বললেন আমেরিকা-ইয়েমেনে ড্রোন হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ওপর হামলার অজুহাত খুঁজছে দেশটি। তো আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের কেউ কেউ সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনার উপর হামলার ব্যাপারে ইয়েমেনি সেনাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে ইয়েমেনি সেনারা ১৭ সেপ্টেম্বর জানিয়েছে যে, তারা প্রতিদিন ৬টি উন্নত মানের ড্রোন তৈরি করে। আপনার কি মনে হয় যে, ইয়েমেনের হুথি সমর্থিত সেনাদের সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় হামলা চালানোর মতো সামর্থ্য নেই?

খন্দকার মুনীরুজ্জামান: দেখুন, এ বিষয়টি আমারপক্ষে বলা খুব কঠিন। কারণ আমি সামরিক বিশেষজ্ঞ নই। তাছাড়া ড্রোন হামলা সম্পর্কে বিস্তারিত খবরাখবর তো আমাদের এখানে সেভাবে পাওয়া যায় না। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, এ ধরনের হামলার সক্ষমতা অর্জন করাটা খুব কঠিন না। আজকের ডিজিটাল যুগ বা ইন্টারনেটের যুগে ড্রোন তৈরি করা বা রিমোটের সাহায্যে ড্রোন পরিচালনা করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এটি এখন আর একচেটিয়া কারও হাতে নেই। একটু দক্ষ হলে যেকোনো দেশ বা যেকেউ এ ধরনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারে বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: এই হামলার ব্যাপারে ইরানকে অভিযুক্ত করলেও আমেরিকা সৌদি আরবের পক্ষে যুদ্ধে যেতে অনীহা প্রকাশ করেছে আমেরিকা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন যে, তিনি সৌদি আরবের পক্ষে যুদ্ধ করতে চান না। টাম্পের এই অবস্থানকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

খন্দকার মুনীরুজ্জামান: আসলে এইমুহূর্তে  মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্ব রাজনীতিতে একটি দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি। যদি ব্যক্তিগতভাবে বলি তাহলে তার মন্দত্বই বেশি। আমেরিকার যাদের সাথে আমার পরিচয় আছে বা তার বাইরেও অনেক আমেরিকানদের মত-ট্রাম্পের মতো একটা লো ক্যালিবারের লোক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছে!

যুদ্ধ করতে চান না বলে ট্রাম্প যে কথাটা বলেছেন সে প্রসঙ্গে বলব- প্রক্সি ওয়ার বলে একটি কথা আছে। তার পক্ষে প্রক্সি ওয়ার করাটা অসম্ভব কিছু না। সরাসরি আমেরিকা যুক্ত হলো না কিন্তু আমরা জানি মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্র আছে। ইসরাইল এবং সৌদি আরব নিজেই আছে। এরবাইরেও কুয়েত আছে। এছাড়া কিছু দেশ আছে যারা সরাসরি আমেরিকার মিত্র। তো আমেরিকা তাদেরকে দিয়ে প্রক্সি ওয়ার করাতে পারে। ফলে এখানে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ হতে পারে।

তবে আমি একটি বিষয় এখানে বলতে চাই সেটি হচ্ছে, ইরান কিন্তু ইরাক নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংহতি, সামরিক শক্তি, শিক্ষা-জ্ঞান বিজ্ঞান এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক সক্ষমতা ইরাকের চেয়ে অনেক বেশি। সেই অর্থে ইরানকে হামলা করা আমেরিকার জন্য একটা বড় ধরনের জুয়া হয়ে যাবে বলে মনে করি। আমেরিকার সিনেট কংগ্রেস কোনোভাবেই ইরানের সাথে যুদ্ধের বিষয়টি অনুমোদন দেবে বলে আমার মনে হয় না। ফলে ট্রাম্পের পক্ষেও সরাসরি একথা বলা সম্ভব নয় যে যে তারা যুদ্ধ করবে। কূটনৈতিকভাবেও সেটি কঠিন কাজ।

রেডিও তেহরান:  অনেকে বলছেন, অ্যামেরিকা বার বার ইরানে বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিলেও সরাসরি কোনো সংঘাতে যাচ্ছে না এর কারণ হচ্ছে আমেরিকার সেই শক্তি নেই। আসলে আমেরিকার কোন শক্তি নেই সামরিক শক্তি নাকি অর্থনৈতিক শক্তি?

খন্দকার মুনীরুজ্জামান: আমি বলব তিনটি ক্ষেত্রেই অর্থাৎ সামরিক, অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক সবক্ষেত্রেই এখন থেকে ২০/২৫ বা ৪০ বছর আগে আমেরিকার যে অবস্থান ছিল এখন সেরকমটি নেই। যেমন ধরুন যদি অর্থনীতির কথা বলেন তাহলে সেখানে দেশটির বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হচ্ছে চীন। প্রায় ২ বছর ধরে চীনের সাথে ট্যারিফ নিয়ে একটা অর্থনৈতিক যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে চীন পরাস্ত হয় নি। চীনের যে প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্র করে আমেরিকা অর্থনৈতিক ঐ যুদ্ধে নেমেছিল সেই কোম্পানি লাভজনক অবস্থায় আছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার যে একচেটিয়া অবস্থান ছিল বিশ্বে সেটি কিন্তু এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। 

সামরিক ক্ষেত্রেও এখন অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে আমেরিকা। আর  ইরানের সাথে সরাসরি যুদ্ধে গেলে ইউরোপ থেকে মিত্র পাবে কি না বিশেষ করে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের যে প্রতিক্রিয়া দেখছি তাতে বিষয়টির সন্দেহের মধ্যে পড়ে।  তারা অনেকে সরাসরি ট্রাম্পের সমালোচনা করছে। ইংল্যাল্ডে সমালোচনা হয়েছে। জার্মানিতেও সমালোচনা হয়েছে। ফলে ইউরোপীয় মিত্রদের যে একটি সমন্বিত সমর্থন আমেরিকা পেত সেটি এখন সেভাবে আছে এমনটি জোর দিয়ে বলা সম্ভব না এবং বোধহয় আমেরিকার নীতি নির্ধারকরাও এমনটি মনে করেন না।

আর সমারিক দিক থেকে আমি আগেও বলেছি, আপনারাও জানেন ইরানের সামরিক সামর্থ্য মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। তাছাড়া রাশিয়াসহ ইরানেরও কিছু মিত্র আছে। স্ট্রাটেজিক ইন্টারেস্টের কারণে চীনও ইরানের মিত্র। ভারতে এখানে ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে সামগ্রিক বিবেচনায় আমেরিকা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এমনটি আমার কাছে মনে হয় না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যটা তাদের জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

রেডিও তেহরান:  ইয়েমেনের উপর সৌদি আরবের যে আগ্রাসন তাকে সারা বিশ্বের মানুষই মন্দ কাজ বলে মনে করছে এবং বেশিরভাগ মানুষ এর নিন্দা জানাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের কথিত নেতা হয়েও কেন সৌদি আরব এই যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছে না অথবা যুদ্ধ বন্ধ করছে না। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ইয়েমেনে সৌদি আরবের বর্বর যুদ্ধ

খন্দকার মুনীরুজ্জামান: দেখুন, ইয়েমেনে অমানবিক যুদ্ধ করছে সৌদি আরব। বলা চলে সরাসরি মানবতাবিরোধী যুদ্ধ করছে সৌদি আরব। ইয়েমেনে যুদ্ধের ফলে অসংখ্য শিশুর মৃত্যু হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। এ বিষয়টি আমরা সকলেই জানি। মিডিয়াতে এসব খবর এসেছে। এর নিন্দা আমরা সবাই করছি।

ইযেমেনে সৌদি আরবের বর্বর যুদ্ধের ফলে অসংখ্য শিশু নিহত হয়েছে

আমার ধারনা এখানে সৌদি আরবের দুটো ইন্টারেস্ট মূল ভূমিকা পালন করছে। আমি যতটুকু জেনেছি সম্ভবত একটি হচ্ছে, সৌদি আরবে যারা ক্ষমতায় আছে তারা ক্রীড়নক সরকার। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে হুথিরা যুদ্ধ করছে। আর ইয়েমেন একটি গেটওয়ে। ফলে সেখানে হুথিরা থাকলে সৌদি আরবের সরকারের অসুবিধা হয়। হুথিরা জয়ী হলে সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের ওপর একটা মানসিক আঘাত আসতে পারে। আর সেটি সৌদি আরবের রাজতন্ত্রকে দুর্বল করতে পারে। এরকমও একটি আশঙ্কা আছে। ফলে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে এরকম একটি অনৈতিক, বর্বর যুদ্ধ করছে সৌদি আরব।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তথাকথিত মুসলিম বিশ্ব এক্ষেত্রে সৌদি আরবের নিন্দা করছে না।

অন্য একটি বিষয়ের কথা বলব। সৌদি আরবে একনায়ত্ব /রাজতন্ত্র চলছে। দেখুন বিষয়টি কেমন প্যারাডক্স। আমেরিকা সবদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বহু সরকারের পতন ঘটিয়েছে তারা। এমনকি অনেক রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। অথচ সৌদি আরবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এরকম প্যারাডক্স মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২২