জুলাই ০৬, ২০২০ ১৪:১১ Asia/Dhaka

হিজরি দশম ও একাদশ শতক বা খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি কবি আবু তালিব কলিম কাশানি ফার্সি কবিতায় ভারতীয় স্টাইল প্রয়োগে সফল শীর্ষস্থানীয় কবিদের অন্যতম।

ইরানি সম্রাট শাহ-আব্বাসের সমসাময়িক যুগের খ্যাতিমান ফার্সি কবি হিসেবে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। সম্রাট শাহজানের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন এই ইরানি কবি। তার কবিতা এই মোগল সম্রাটের কাছে খুবই ভালো লাগায় তিনি তাকে মালেক উশ শোয়ারা উপাধি দিয়েছিলেন।  

কলিম কাশানি ছিলেন এমন একজন বিখ্যাত কবি যার কবিতা বা কাব্য-সমগ্রের খ্যাতি ও গুণগানের আড়ালে হারিয়ে গেছে তার ব্যক্তি-জীবন। তার ব্যক্তি-জীবন সম্পর্কে যারা লিখেছেন তারা তার নানা মহৎ গুণের কথাই তুলে ধরেছেন। ফলে তার জন্ম-সন, জন্মের স্থান এবং বংশধরের অস্তিত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায়নি। কলিম কাশানি নিজেও তার কোনো বইয়ে এসব বিষয়ে কিছু লেখেননি।

নানা বর্ণনা ও আভাস-ইঙ্গিতের আলোকে মনে করা হয় যে সম্ভবত হিজরি ৯৮০ সনে জন্ম নিয়েছিলেন কবি আবুতালিব কলিম কাশানি। কোনো কোনো গবেষকের মতে তার জন্ম হয়েছিল হামাদানে এবং তিনি বড় হন কাশানে। অন্য একদল মনে করেন কলিম কাশানির জন্ম হয়েছিল কাশানে এবং তিনি বড় হন হামাদানে। কলিম কাশানির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একদল গবেষক মনে করেন এই কবির জীবদ্দশাতেই তার জন্ম-তারিখ ও জন্মের স্থান নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। কিন্তু কবি নিজেই চাইতেন যে মানুষের কাছে এটা অজ্ঞাতই থেকে যাক যে তিনি কোন্‌ অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। তার কোনো কোনো কবিতার আলোকে মনে হয় যে তিনি জন্মেছিলেন কাশানে। আবার কোনো কোনো কবিতার আলোকে মনে হয় তিনি জন্মেছিলেন হামাদানে। সম্ভবত কলিম কাশানি নিজের ইরানি পরিচয়টাকেই বড় করে দেখতেন। ইরানের কোন্ অঞ্চল তার জন্মভূমি এটা ছিল তার কাছে গৌণ বিষয়। কোনো কোনো বর্ণনায় বল হয় যৌবনে কলিম কাশানি খুব শীর্ণকায় ছিলেন এবং তিনি দরবেশদের মত জীবন যাপন করতেন। তিনি কখনও বিয়ে করেননি এবং এক শ্রেণীর খোদাপ্রেমিক দরবেশদের অনুকরণ করতে গিয়েই তিনি অবিবাহিত থাকেন।

কবি আবুতালিব কলিম কাশানি প্রচলিত পড়াশুনা করেছিলেন শিরাজ ও হামাদানে। তিনি ভারতের মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে ভারতে যান। এ সময় তার বয়স ছিল অনূর্ধ্ব ২৪ বছর। সম্রাটের রাজসভা বা দরবারের কবি হওয়ার ইচ্ছা তার ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু জাহাঙ্গীরের সাহিত্য সভায় বড় বড় কবি ও সাহিত্যিকদের সারিতে ঠিক সে সময়ই যুবক কলিমের ঠাঁই পাওয়ার মত যোগ্যতা ছিল না।

কলিম বেশ কিছুকাল ভারতের দাক্ষিণাত্যসহ নানা রাজ্যে বসবাস করেন এবং হিজরি ১০২৮ সনে ৩৮ বছর বয়সে ইরানে ফিরে আসেন।

এরপর হিজরি ১০৩০ সনে ভারতের গভীর টানে কবি আবুতালিব কলিম কাশানি ইরান থেকে আবারও সেখানে ফিরে যান।  আর এ সময় কলিমের রচিত একটি রুবাই বা চতুর্পদি কবিতা ভারতের রাজ-দরবারে তার প্রবেশের পথ করে দেয়। ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বড় মোঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজসভার প্রধান কবি তথা মালিক আশ শোয়ারার পদে আসীন হন কলিম। অবশ এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করেছিলেন মিরজুমলা শাহরেস্তানি। আমৃত্যু এ পদে আসিন ছিলেন কলিম। যে স্বর্ণ ও অর্থ তিনি পেতেন মোঘল রাজ-দরবার থেকে তা তিনি গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। 

কবি আবুতালিব কলিম কাশানির সাহিত্য-কর্মের মধ্যে রয়েছে মাসনাভি বা দ্বিপদী কবিতা, কাসিদা, গজল ও আরও নানা আঙ্গিকের কবিতা। তার রচিত দিওয়ান বা কুল্লিয়াত তথা কবিতা-সমগ্র শীর্ষক রচনার সব কবিতার পঙক্তির সংখ্যা অনূর্ধ্ব দশ হাজার। তার আরেকটি বড় রচনা বা কাব্য হল 'মাসনাভিয়ে শাহনামেহ' তথা দ্বিপদী ছন্দে লেখা শাহনামা কাব্য। কলিমের এই কাব্যটি 'জাফরশাহে জাহানি' নামেও খ্যাত।

ভারতের আকবরাবাদ শহরের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে গেলে আজও সবাই দেখতে পাবেন সেইসব ভবনে উৎকীর্ণ রয়েছে কবি কলিম কাশানির লেখা কবিতার অংশ। মসজিদে শাহজাহান ও বিখ্যাত লাল-কেল্লার বাদশাহি বা সরকারি ভবনগুলোয় কবি কলিমের কাসিদার উৎকীর্ণ অংশগুলোর কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। 

১০৬১ হিজরিতে কবি আবুতালিব কলিম কাশানি ইন্তেকাল করেন কাশ্মির অঞ্চলে। তার বয়স হয়েছিল ৭০। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। শ্রীনগর অঞ্চলে রয়েছে তার সমাধি। তার কবরের আশপাশে অনেক মাজার রয়েছে। আর তাই এই এলাকাকে বলা হয় মাজার-পাড়া। কিন্তু কলিম কাশানির কবরের ওপর নেই কোনো সৌধ। আশপাশের কাউকে প্রশ্ন করলে সাধারণত তার কবরের স্থানটি চেনা তো দূরের কথা এই নামের কোনো ব্যক্তি সম্পর্কেই তারা অজ্ঞতার কথা জানাবেন। কলিম কাশানি জীবনে যেমন ছিলেন সহজ-সরল বা সাদামাটা তেমনি তিনি মারাও যান নির্জনে সাদামাটাভাবে এবং তার কবরের স্থানটিও হয়েছে সাদামাটা। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।