ডিসেম্বর ১৭, ২০২০ ১৯:২৯ Asia/Dhaka

আমরা ইরানের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে চালানো ‘মুসলিম বিন আকিল’ অভিযান নিয়ে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই অভিযানের অর্জন অর্থাৎ ওই অভিযানের জের ধরে জাতিসংঘের কথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরান-ইরাক যুদ্ধ বা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ শুরু হওয়ার দ্বিতীয় বছরের শেষদিকে রমজান অভিযান চালানোর পর ইরান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়া যাবে না বরং বিভিন্ন ফ্রন্টে সাদ্দাম বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে হবে। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের অভিযান চালানোর প্রস্তুতি না থাকায় ইরান বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ছোট ছোট অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ১০০ কিলোমিটার পূর্বে ইরান-ইরাক সীমান্তের একটি পার্বত্য এলাকায় ‘মুসলিম বিন আকিল’ অভিযান চালানো হয়।

গত আসরে আমরা এই অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করেছি। ওই অভিযানে ইরানের বিজয় প্রমাণ করে ইরানি যোদ্ধারা দেশের দক্ষিণ সীমান্তের সমতলভূমির পাশাপাশি মধ্যাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায়ও যুদ্ধ করতে পারদর্শী। এই অভিযানে ইরান বিজয়ী হওয়ার পর ইরাকি বাহিনী এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কাপুরুষোচিত পন্থা অবলম্বন করে। ‌ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি পাঁচ তলা হোটেলের সামনে ইরাকের অনুচর বাহিনী ১৫০ কেজি বিস্ফোরক ভর্তি একটি ট্রাকের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটায়। তেহরানের নাসের খসরু রোডে অবস্থিত হোটেলটির সামনে ওই হামলায় শত শত মানুষ হতাহত হয়।

ওই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ইসলামি ইরানের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) এক বাণীতে বলেন, যখনই আমাদের বীর-মুজাহিদরা যুদ্ধের ময়দানে বিজয় অর্জন করেন তখন ইরান ও ইসলামের শত্রুরা কিছু নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষের রক্ত ঝরায় এবং তারা ধারনা করে যে, এ ধরনের কাপুরুষোচিত হামলার মাধ্যমে তারা ইরানি যোদ্ধাদের সংকল্পে ফাটল ধরাতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তারা ঈমানের শক্তি দেখেনি বরং পশ্চিমা চিন্তাধারা দিয়েই তারা সবকিছুকে বিচার করতে চায়।

ঠিক এই সময়ে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠী নিজেকে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের জন্য উৎসর্গ করে দেয় এবং সাদ্দামের নির্দেশ পালন করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।

দেশদ্রোহী মোনাফেকিন গোষ্ঠী ইরানের বিমান বাহিনীতে থাকা অনুচর বাহিনীর সহযোগিতায় ইরানের একটি সি-১৩০ বিমান অপহরণ করে পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ উপকূলের একটি আরব দেশে নিয়ে যায়। এই ঘটনার ১০ দিন পর এই গোষ্ঠী ইরানের কেরমানশাহ শহরের জুমার নামাজের খতিব আয়াতুল্লাহ আশরাফি ইস্পাহানিকে জুমার নামাজের ময়দানে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করে।  মোনাফেকিন গোষ্ঠী চেয়েছিল, ইরানের প্রভাবশালী আলেম ও খতিবদের হত্যা করার মাধ্যমে জনগণকে ইরাকি শক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত করার কাজ ব্যহত করা। আয়াতুল্লাহ আশরাফি ইস্পাহানির বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইরানি যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য ফ্রন্টে চলে যেতেন, তাদের উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন এবং তাদের নামাজের ইমামতি করতেন।     

মুসলিম ইবনে আকিল অভিযানের পর ওই ঘটনা ব্যবহার করে ইরাকের সাদ্দাম সরকার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করে এবং বিশ্বব্যাপী এই প্রচার চালায় যে, ইরান আগ্রাসী শক্তির ভূমিকায় চলে গেছে। ওই অভিযানের প্রথম দিনই ইরাকের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদান হাম্মাদি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন। তিনি অবিলম্বে ইরাকের অভ্যন্তরে ইরানি হামলার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক ডাকার অনুরোধ করেন।  এ সময় জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরাকের স্থায়ী প্রতিনিধিও একই অনুরোধ জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে দরখাস্ত পেশ করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরই ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি খবর দেয়: নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি ইরাকের দরখাস্ত মঞ্জুর করেছে এবং বাগদাদকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি ওই পরিষদকে জানাতে বলেছে।

এর তিনদিন পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে আরব দেশগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে মরক্কোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মাদ বুস্তা বক্তব্য রাখেন। তিনি আগ্রাসী ইরাককে ‘শান্তিকামী’ হিসেবে উল্লেখ করে জাতিসংঘের ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ’কে সহযোগিতা করার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানান।  বৈঠকে ইরাকের স্থায়ী প্রতিনিধির পরিবর্তে ইরাকের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাদুন হাম্মাদি স্বয়ং উপস্থিত হন এবং ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানান। বৈঠক শেষে নিরাপত্তা পরিষদ এ যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপারে ৫২২ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করে।  সাত-ধারা বিশিষ্ট ওই প্রস্তাবে ইরাক-ইরান যুদ্ধের আগ্রাসী দেশকে যেমন চিহ্নিত করা হয়নি তেমনি আগ্রাসনের শিকার দেশকে ক্ষতিপূরণ দেয়ারও কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবে এর আগের (৫১৪ নম্বর) প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ইরাককে ধন্যবাদ জানানো হয় এবং আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় দু’দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানানো হয়। এ সময় জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি রাজায়ি খোরাসানি এক বিবৃতিতে বলেন, তার দেশের পক্ষ থেকে দেয়া শর্তগুলো মেনে নিলেই কেবল তিনি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে অংশ নেবেন। শর্তগুলো হচ্ছে, চলমান যুদ্ধের আগ্রাসী দেশের নিন্দা জানাতে হবে, ইরানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং ইরান থেকে ইরাকে নির্বাসিত ব্যক্তিদের ফেরত দিতে হবে। পাশাপাশি তিনি এক সাক্ষাৎকারে ইরাককে ব্যাপকভাবে ছাড় দেয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে দায়ী করে বলেন, ইরান চলমান যুদ্ধে আগ্রাসনের শিকার হয়েছে এবং দেশটি এ পর্যন্ত যেসব সামরিক অভিযান চালিয়েছে তা শুধুমাত্র আগ্রাসী বাহিনীকে ইরানের ভূমি থেকে বিতাড়নের জন্য পরিচালিত হয়েছে।

রাজায়ি খোরাসানি নিরাপত্তা পরিষদের ৫২২ নম্বর প্রস্তাব পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, জাতিসংঘ ঘোষণায় এ পরিষদের ওপর নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দায়িত্ব পালেনের যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা রক্ষা করতে এই পরিষদ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আরো বলেন: ইরাক যখন আগ্রাসন চালিয়ে ইরানের ২০টি শহর ও বারশ’ গ্রাম দখল করে নিয়েছিল, ইরানের ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদ ও হাসপাতালসহ বেসামরিক স্থাপনাগুলো টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছিল এবং দেশটির আগ্রাসনে ২০ লাখ ইরানি বাস্তুহারা হয়েছিল তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তার দায়িত্ব পালন করেনি বরং নীরবতা অবলম্বন করেছে।

ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরাকের এই রাজনৈতিক চালবাজি ও জাতিসংঘের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ সম্পর্কে সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে বলেন: আমরা শান্তি চাই এবং যেকোনো শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে এমন একটি সম্মানজনক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যেখানে সবাই দেখবে যে, আগ্রাসী শক্তি ইরানের কি পরিমাণ ক্ষতি করেছে এবং সেই ক্ষতি পুষিয়েও দিতে হবে।পাশাপাশি তিনি ঈদুল আজহা উপলক্ষে গিনির প্রেসিডেন্টের পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তার জবাবে বলেন: আমরা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কিন্তু আমাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নিতে হবে। এত নিরপরাধ মানুষের রক্ত ঝরানো এবং বিপুল পরিমাণ অবকাঠামো ধ্বংসকারী শক্তিকে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয়া যাবে না।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।