আলজেরিয়ায় বুতেফলিকার ১৮ বছরের শাসন
১৩২ বছর ধরে ফ্রান্সের উপনিবেশ থাকার পর ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে আলজেরিয়া।
অন্তত দশ লাখ আলজেরিয় নাগরিক শাহাদত বরণ করেছিল মুসলিম ও আরব এই দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাই দেশটিকে বলা হয় মিলিয়ন শহীদের দেশ।
পশ্চিম-উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশ আলজেরিয়ায় ১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত শাসকের পালাবদল হয়েছে ৭ বার এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোট ৫ জন ব্যক্তিত্ব।
স্বাধীনতার পর আলজেরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন আহমাদ বেন বেল্লা। তিনি দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুয়ারি বুমেদিন। ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর হুয়ারি বুমেদিন মারা যান ১৯৭৮ সালে। এরপর আলেজেরিয়ায় ক্ষমতাসীন হন সাদলি বেনজাদিদ। ১৪ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পর বেনজাদিদ সেনাবাহিনীর চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ সময়ই অর্থাৎ ১৯৯২ সালে আলজেরিয়ার সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে ইসলামী স্যালভেশন ফ্রন্টের ক্ষমতা গ্রহণের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠন করে একটি সুপ্রিম কাউন্সিল। এ পরিষদ ক্ষমতাসীন ছিল ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এ পরিষদের প্রধান ছিলেন যথাক্রমে মুহাম্মাদ বুসিয়াফ ও আলী কাফি। বুসিয়াফ ১৯৯২ সালে নিহত হলে ক্ষমতাসীন হন আলী কাফি। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কাউন্সিল বিলুপ্ত করা হয় এবং প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি পুনরায় চালু করা হয় আলজেরিয়ায়। নতুন প্রেসিডেন্ট হন আমিন জারুয়াল। তিনি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পরের বছর মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হন আবদুল আজিজ বুতেফলিকা। সেই থেকে এখনও ১৮ বছর ধরে ক্ষমতাসীন রয়েছেন বুতেফলিকা।
স্বাধীনতার পর আলজেরিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাসক বুতেফলিকা মোট চারটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এই চারটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯, ২০০৪,২০০৯ এবং ২০১৪ সালে। এর আগে ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এবং কিছু সময়ের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টও ছিলেন।

যে চারটি নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছেন তার সব ক’টিতেই ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও নানা অনিয়ম আর কারচুপির অভিযোগে বুতেফলিকার মোট ৬ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগিতা বর্জন করেন। আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হল বুতেফলিকা ২০১৪ সালে পর পর চতুর্থবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হন। এ সময় স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার কারণে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারেননি।
বুতেফলিকার শাসনামলে তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্বটি হল আলজেরিয়ায় দশ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো। সংসদ নির্বাচনে ইসলামী স্যালভেশন ফ্রন্টের প্রায় নিশ্চিত বিজয় বাতিল করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল সেই গৃহযুদ্ধ। এই গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে দেড় থেকে দুই লাখ আলজেরিয়।
গৃহযুদ্ধ মোকাবেলার জন্য ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বুতেফলিকাকে বজায় রাখতে হয়েছিল জরুরি অবস্থা। কঠোর হাতে দেশ চালানো ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশকে শক্তিশালী করার নীতি গ্রহণ করেছেন বুতেফলিকা।
আলজেরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী একই ব্যক্তি ৫ বছরের মোট দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। কিন্তু বুতেফলিকা ২০০৮ সালে সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। ফলে ২০০৯ সালের নির্বাচনে তিনি তৃতীয়বারের মত ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি টানা চতুর্থবারের মত আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন।
বুতেফলিকার বিরোধীরা বলে থাকেন তিনি যেসব নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন তা ছিল প্রহসনের নির্বাচন এবং এসব নির্বাচনে কেবল কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বুতেফিলকারই কয়েকজন অনুচর! ২০০৯ সালের নির্বাচনের সময় আলজেরিয়ার কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম বুতেফলিকার কথিত নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের‘খরগোশ’ বলে অভিহিত করেছিল। বুতেফলিকা শেষ তিনটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অর্থ দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন এবং কৃষকসহ নিম্ন-আয়ের লোকদের ঋণ-মওকুফ করেন ও ছাত্রদের বৃত্তি বাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনে কারসাজি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অবশেষে বুতেফলিকার শাসনামলে গত বছর সংবিধানে আবারও সংশোধনী আনা হয়েছে। এ সংশোধনী অনুযায়ী আলজেরিয়ায় একনাগাড়ে দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে না পারার অতীত বিধানটি পুনর্বহাল করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে ভবিষ্যতে কোনও পুনর্বিবেচনা করা যাবে না বলে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও স্বাধীন ও স্থায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে।
বুতেফলিকা সংবিধানে এ দুই সংশোধনী আনতে বাধ্য হয়েছেন ব্যাপক গণদাবীর কারণেই। ফলে আলজেরিয়ায় বুতেফলিকার কঠোর শাসনামলের অবসান ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। বুতেফলিকার ১৮ বছরের শাসনামলে সংসদ ছিল অকার্যকর। এ সময় দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও গণতন্ত্র হয়েছে দুর্বল এবং বেড়েছে স্বজনপ্রীতি। এ সময়ে আলজেরিয়ার ইসলামী আন্দোলনগুলোও হয়েছে দুর্বল। ২০১১ সালে আরব বিশ্বে সরকার-বিরোধী গণ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লেও আলজেরিয়ার ইসলামপন্থীরা বুতেফলিকা-বিরোধী বিক্ষোভের আয়োজন করতে ব্যর্থ হয়।
বুতেফলিকার গত ১৮ বছরের শাসনের মধ্যে গৃহযুদ্ধের অবসান ও তেলের দর বাড়ার সুবাদে আলজেরিয়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। তবে দেশটির অর্থনীতি এ সময়ে হয়ে পড়েছে খুব বেশি তেল-নির্ভর। দেশটির জাতীয় উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ, সরকারি আয়ের দুই তৃতীয়াংশ এবং রপ্তানি আয়ের ৯৫ শতাংশের উৎস হল জ্বালানী তেল।
আলজেরিয়া তেল রিজার্ভের দিক থেকে আফ্রিকায় দ্বিতীয় ও গ্যাসের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেলের দর কমে যাওয়ায় দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশ থেকে কমে প্রায় তিন শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বেকারত্বের হার প্রায় ২২ শতাংশ যদিও সরকারিভাবে বলা হয় দশ শতাংশ। আলজেরিয়ার সরকারি আয়ের একটা বড় অংশই ব্যয় করা হয় ভর্তুকির খাতগুলোতে।
বুতেফলিকার ১৮ বছরের শাসনামলে আলজেরিয়া পররাষ্ট্র-নীতিতে থেকেছে স্বাধীন। যেমন, সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়াকে আরব লিগ থেকে বহিষ্কারের ও লেবাননের হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী দল বলে ঘোষণা দেয়ার সৌদি নেতৃত্বাধীন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। যেসব আরব দেশ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ দেয়নি, বরং এ জোটের বিরোধিতা করেছে আলজেরিয়া তাদের অন্যতম। আলজেরিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি (২০১৬) দামেস্ক সফর করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
অথচ এই সফরের আগে সৌদি যুবরাজ আলজেরিয়া সফরে এসে দেশটিতে কয়েক শত কোটি ডলারের অর্থ বিনিয়োগের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে আলজিয়ার্সকে নিজ শিবিরে ভেড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু বুতেফলিকা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। মিশরের সিসি’র মত তিনি সৌদি পতাকার নীচে থাকতে রাজি হননি।
৭৯ বছর বয়স্ক বুতেফলিকা অসুস্থ হওয়ায় তার মৃত্যুর খবর বা গুজব মাঝে-মধ্যে প্রচার হচ্ছে। তার ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালে। আলজেরিয়ায় সামাজিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যাও কম নয়। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে সেখানে ৬২০০টি প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে। কোনও কোনও অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সংঘাতও রয়েছে। #
পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/৬