‘ইরান ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অত্যন্ত সমৃদ্ধ’
-
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী
বাংলাদেশের নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ইরান শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে একটি সমৃদ্ধ দেশ। ইরানি জাতি একটি দেশপ্রেমিক জাতি। ইরানি জাতি তাদের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা রক্ষার জন্যে রক্ত দিয়েছে। আমরাও ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছি। ইরানের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক সম্পর্ক।’
ইরানি নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে গতকাল (শুক্রবার) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নৃত্যকলা মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও শিল্পকলা একাডেমী যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে।
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী তার বক্তব্যে আরও বলেন, “ইরান ও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পারস্য সভ্যতার দেশ হলো ইরান। পারস্য সভ্যতার কথা কে না জানে। ইরানের সাথে বাংলাদেশর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইরান শিল্প সাহিত্যের দেশ। শিল্পকলায় ইরান ঐতিহাসিকভাবেই এগিয়ে। বিখ্যাত কবি লেখক মনীষীরা ইরানে জন্মগ্রহণ করেছেন। ইরান ও বাংলাদেশের মানুষের ধর্মীয় চেতনাই প্রকৃত চেতনা। সেই ধর্মীয় চেতনা অত্যন্ত মানবিক। ইরানের প্রতি পাশ্চাত্য শক্তি বিশেষ করে আমেরিকার আচরণ অত্যন্ত বৈষম্যমূলক।”
তিনি বলেন, “আমরা বাংলাদেশীরা শান্তির পক্ষে। বংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ছিল কারো সাথে শত্রুতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব। আমরা চাই প্রতিটি মানুষ শান্তিতে থাকুক। যুদ্ধাংদেহী পরিবেশের পক্ষে আমরা নই। কোন জাতির প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ সমীচীন নয়। পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ ও মানবিক পরিবেশ হলেই জ্ঞানবিকাশ ও সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ তৈরি হয়। আগ্রাসন ও আতঙ্কগ্রস্ততার ভেতর দিয়ে সেটি হতে পারে না।”

‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনায় ইরান এশিয়ার গর্ব’: মামুনুর রশীদ
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “মোঘলরা যে সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিল সেটা ছিল পারস্যের সংস্কৃতি। পারস্যের সাথে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক ছিল আমাদের। আমাদের বিশ্বাসের মধ্যে, আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের মধ্যে পারস্য সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে। সাত হাজার ফারসি শব্দ সরাসরি বাংলায় প্রবেশ করেছে। আর হাজারো শব্দ পরিবর্তিত হয়ে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দ প্রবেশ করেছে প্রায় তেত্রিশ হাজার। মোঘল শাষক আকবর এই বাংলা নববর্ষ প্রবর্তন করেছেন। তার নির্দেশে আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী বাংলা সনের উদ্ভাবন করেছেন। যিনি ছিলেন একজন নক্ষত্রবিদ। তাঁর জন্মস্থান ইরানে সিরাজ নগরে।”
মামুনুর রশীদ আরও বলেন, “ইরানের সাহিত্য আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। ইরানে সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নজরুল অগণিত ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। তিনি অনুবাদ করেছেন ফারসি কবিতা দিওয়ানে হাফিজ। রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম। ফেরদৌসীর শাহনামা আমাদের আমাদের সাহিত্যকেও আলোকিত করেছে। শাহনামার সোহরাব-রুস্তম আমরা পাঠ্যপুস্তকে যেমন পড়েছি। তেমনি হয়েছে নাটক, যাত্রা-পালা। সম্রাট বাবার যদিও ‘বাবরনামা’ লিখেন তুর্কি ভাষায়। কিন্তু শেষ মোঘল সম্রাট বাহদুর শাহ জাফর উঁচু মানের ফারসি কবি ছিলেন।”
ইরানি চলচ্চিত্রের প্রশংসা করে মামুনুর রশীদ বলেন, “আধুনিক চলচ্চিত্রে ইরান শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। তাদের অভিনয় মানবিক। ইরানি সিনেমার কাহিনী যেন আমাদের দেশের কাহিনী। ইরানের পথনাটক অত্যন্ত সুন্দর। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিশ্বনাটক পর্বে যে নাটকগুলো দেখানো হয় পাশ্চাত্যের নাটক। ইউরোপ-আমেরিকার নাটক। আমি প্রস্তাব দিয়েছি ইরানি নাটকের ব্যাপারে। আমরা ইরান ও তুরস্কের নাটকের জন্যে চেষ্টা করছি।”
তিনি বলেন, “ইরান কঠোরভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাসহ সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে একাই লড়ে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে ইরান এশিয়ার গর্ব।”

‘নওরোজে ইরানিদের মধ্যে উৎসবের আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ও ফারসি ভাষায় নজরুল বিশেষজ্ঞ ড. কাজেম কাহদুয়ী বিশেষ অতিথির ভাষণে ‘ইরানি নওরোজের তাৎপর্য তুলে ধরেন ও হাফত সিনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, নওরোজে ইরানিদের মধ্যে উৎসবের আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। ইরানি জনগণ এসময় পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। আত্মীয়-স্বজনদেরকে দেখতে যায়। কবর জিয়ারত করে। গুরুজনকে শ্রদ্ধা জনায়। ঘরদোর পরিষ্কার করে। বেড়াতে যায়। পার্কে, নদীর পাড়ে, সমুদ্রতীরে শহর থেকে দূরে।

‘সুফিবাদের দিক থেকে ইরান ও আমরা সমমনা’
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, “ইসলাম পরমত পরধর্ম সহিষ্ণুতার ধর্ম। ইরানের মুসলমানরা একইসাথে মুসলমান ও মানবিক। কারণ ইরানে বিকশিত হয়েছে সুফিবাদ। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী, ফরিদউদ্দিন আত্তার প্রমূখ-এর মাধ্যমে সুফিবাদ বিকশিত হয়েছে। সুফিবাদ ইসলামের সারকথা। ইসলাম মানুষের জন্যে। সুফিবাদ মানুষের আত্মাকে আলোকিত করে। এই দিক দিয়ে ইরান ও আমরা সমমনা। সুফিবাদের মূলকথা মানুষের মানবিক বিকাশ ও মানুষের আত্মার বিকাশ। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী ছিলেন বিখ্যাত কবি। আমাদের কবিরাওতো সেই মানবিকতার কথাই বলে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানবতার কথা বলেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবজাতিকে রক্ষার জন্যে মানুষের মানবিক মূল্যবোধকে বিকশিত করার জন্যে কথা বলেছেন।”
তিনি বলেন, “ইরান শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ দেশ। ইরানি সিনেমা মানবিক ও সমাজ সংস্কারমূলক। হৃদয়কাড়া তাদের অভিনয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে ইরানি সিনেমা। কান চলচিত্র উৎসব সব সময়তো ইরানেরই দখলে থাকে।”
শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক আরও বলেন, “বাংলাদেশ ও ইরানের মাঝে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পূর্বেও ছিল এখনো আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। দু দেশের সাংস্কৃতিক বিনিয়ম হয়েছে এবং আরো হওয়া দরকার। ইরান থেকে একটি সাংস্কৃতিক দল আসার কথা। আমরা যোগাযোগ রাখছি।”

আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সিলর ড. সাইয়েদ মাহদী হোসাইনী ফায়েগ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান কথাশিল্পী ড. আবদুস সবুর খান।
ড. কাজেম কাহদুয়ীর বক্তব্য বাংলায় ভাষান্তর করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আহসানুল হাদী। পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। তেলাওয়াত করেন ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা।

আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (র)-এর নওরোজ সম্পর্কিত গান ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা নববর্ষের জনপ্রিয় গান ‘এসো হে বৈশাখ' গেয়ে শোনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক কণ্ঠশিল্পী মেহেদী হাসান ও তাঁর দল। এছাড়া বাউল কণ্ঠে লালনগীতি ও লোকজ সঙ্গীত পরিবেশিত হয়।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৩