ইস্ফাহান কীভাবে ইরানের হস্তশিল্পের কেন্দ্র হয়ে উঠল?
পার্সটুডে: শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইস্ফাহানের কারিগররা মিনাকারি (ধাতুর উপর নকশা), কালামকারি (কাপড়ের উপর ব্লক প্রিন্ট) ও খাতামকারির (কাঠের উপর সূক্ষ্ম কাজ) মতো ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পকে সযত্নে রক্ষা করে আসছেন।
ইরানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ইস্ফাহান প্রদেশ সবসময়ই দেশের হস্তশিল্পের রাজধানী হিসেবে পরিচিত। এখানে হস্তশিল্পকে কেবল স্মারক বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে দেখা হয় না, বরং এটি এখন একটি বিলিয়ন ডলারের শিল্পে রূপ নিয়েছে, যা বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে এবং একইসাথে রপ্তানি ও পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করছে।
প্রেস টিভির বরাতে পার্স টুডে জানিয়েছে, ইস্ফাহানের কারিগররা তাঁদের দক্ষতাকে স্থানীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ধরে রেখেছেন। বাজার ও কারখানার ওস্তাদ শিল্পীরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁদের জ্ঞান ও দক্ষতা হস্তান্তর করে চলেছেন, এভাবেই ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষিত হচ্ছে।
সাফাভি যুগ থেকে বিশ্বখ্যাত
সাফাভি আমলে ইস্ফাহানকে 'ইরানের হস্তশিল্পের মুকুটমণি' বলা হতো। আজও এখানকার শিল্পীরা সেই ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন। মিনাকারি, খাতামকারি, কালামজানি, আয়না-কাজ, ফিরোজা-খচিত কাজ, গালিচা বোনা, মৃৎশিল্প, টালি-কাজ, সূচিশিল্প এবং কালামকারি— এ সবই ইস্ফাহানের কারিগররা জীবিত ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছেন।

ইরানের ৬০ শতাংশ হস্তশিল্প ইস্ফাহানে তৈরি
ইরানের মোট হস্তশিল্পের প্রায় ৬০ শতাংশই ইস্ফাহানে উৎপাদিত হয়। দেশের ৩০০ হস্তশিল্প শাখার মধ্যে ২০০টি এখানেই প্রচলিত। প্রায় ৭০ হাজার শিল্পী ও ৯ হাজার কর্মশালা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ শিল্পের রপ্তানি এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা স্পষ্ট করে। ১৪০২ সালের অর্থবছরে (মার্চ ২০২৩ – মার্চ ২০২৪) ইস্ফাহানের হস্তশিল্প রপ্তানি ১৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছাড়িয়েছে, যা আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ। কেবল গত নয় মাসে (২১ মার্চ থেকে ২০ ডিসেম্বর ২০২৪) রপ্তানি আয় হয়েছিল ৭.৬ মিলিয়ন ডলার।
পর্যটন: বিকাশের মূল চালিকাশক্তি
ইস্ফাহানের হস্তশিল্প শিল্পের বিকাশে পর্যটন বড় ভূমিকা রাখছে। ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজ ১৪০৪ (মার্চ ২০২৫) উৎসবে প্রায় ১৬ লাখ পর্যটক ইস্ফাহান ভ্রমণ করেছেন। এ সময় ৬০০টি হস্তশিল্প স্টল থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন রিয়াল বিক্রি হয়েছে।

বৈশ্বিক স্বীকৃতি
২০১৫ সালে বিশ্ব হস্তশিল্প পরিষদ ইস্ফাহানকে 'বিশ্ব হস্তশিল্প নগরী' হিসেবে ঘোষণা করে, যা প্রথম কোনো শহরের জন্য দেওয়া স্বীকৃতি। ২০২৩ সালে ইউনেসকো ইস্ফাহানকে 'সৃজনশীল হস্তশিল্প ও লোকশিল্পের শহর' হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। একই বছর কালামকারি (কাঠের ছাপ দিয়ে কাপড়ে নকশা আঁকা শিল্প) বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তুলো কাপড়ে তৈরি এ শিল্পে ফুল, জ্যামিতিক নকশা ও ক্যালিগ্রাফি দেখা যায়, যা কার্পেট বোনা শিল্পের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
মিনাকারির পর কলমকারি ছিল ইস্ফাহানের দ্বিতীয় শিল্প, যা বিশ্বব্যাপী নিবন্ধিত হয়। ২০২৪ সালে সাত-রঙা টালি-কাজ বৈশ্বিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এ টালিগুলো আজও ইস্ফাহানের বিখ্যাত স্থাপত্য যেমন ইমাম মসজিদ ও শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদে চোখে পড়ে। এ সম্মাননা শুধু প্রতীকী নয়— বরং এটি পর্যটক আকর্ষণ, আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণ ও ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

হস্তশিল্প: তেলের বিকল্প
ইরানের অর্থনীতিতে হস্তশিল্প তেলের একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে। এতে বিশাল অবকাঠামোর প্রয়োজন হয় না, বহুমুখী কর্মসংস্থান তৈরি হয় এবং সাংস্কৃতিক কূটনীতিতেও অবদান রাখে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, হস্তশিল্প ইরানের অন্যতম শক্তিশালী তেলবহির্ভুত রপ্তানি খাত হয়ে উঠেছে। বহু শিল্পীর জন্য এটি নিরবচ্ছিন্ন আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে।
মিনাকারি, খাতামকারি, গালিচা বোনা কিংবা কালামজানি— ইস্ফাহানের কর্মশালাগুলো প্রমাণ করে, ঐতিহ্যবাহী শিল্প কীভাবে আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে রূপান্তরিত হতে পারে এবং একই সঙ্গে ইরানের সার্বিক অগ্রগতিতে অবদান রাখতে পারে।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৬