ইস্ফাহানের নিউ জুলফা: সাংস্কৃতিক বিনিময়, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শিল্পের জীবন্ত প্রতীক
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i152154-ইস্ফাহানের_নিউ_জুলফা_সাংস্কৃতিক_বিনিময়_ধর্মীয়_সহনশীলতা_ও_শিল্পের_জীবন্ত_প্রতীক
পার্সটুডে: নিউ জুলফা হলো একটি প্রাচীন আর্মেনিয় বসতি, যা সাফাভি যুগে ইরানের ইস্ফাহান শহরের দক্ষিণে জায়েনদেহ রুদ নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই আর্মেনিয় বসতি সাংস্কৃতিক বিনিময়, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শৈল্পিক সৌন্দর্যের একটি জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
(last modified 2025-09-20T14:12:15+00:00 )
সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫ ১৮:৩১ Asia/Dhaka
  • ইস্ফাহানের নিউ জুলফা: সাংস্কৃতিক বিনিময়, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শিল্পের জীবন্ত প্রতীক

পার্সটুডে: নিউ জুলফা হলো একটি প্রাচীন আর্মেনিয় বসতি, যা সাফাভি যুগে ইরানের ইস্ফাহান শহরের দক্ষিণে জায়েনদেহ রুদ নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই আর্মেনিয় বসতি সাংস্কৃতিক বিনিময়, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শৈল্পিক সৌন্দর্যের একটি জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে।

প্রেসটিভি'র বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, সরু গলির পাশে ইটের বাড়ি, খোদাই করা কাঠের বারান্দা এবং শান্ত বাগান নিউ জুলফা বসতিতে এক অনন্য পরিবেশ তৈরি করেছে যেন শহরের মধ্যে আরেক জগত।

এই এলাকা নির্বাসনের মাধ্যমে গড়ে উঠলেও, এটি আধুনিক প্রাচীন ইতিহাসে সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের উজ্জ্বল উদাহরণ এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

নিউ জুলফার ইতিহাস শুরু হয় ১৬০৬ সালে, যখন সাফাভি শাসক শাহ আব্বাস হাজার হাজার আর্মেনিয় পরিবারকে পুরোনো জুলফা থেকে ইস্ফাহানের নতুন রাজধানীতে স্থানান্তর করেন। এই পদক্ষেপ প্রথমে নির্বাসন মনে হলেও, এর লক্ষ্য ছিল আর্মেনিয়দের ওসমানীয়দের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা এবং সাফাফি রাজ্যের কৌশলগত শক্তি বৃদ্ধি করা।

আর্মেনিয়রা ছিলেন দক্ষ ব্যবসায়ী, শিল্পী এবং কূটনীতিক। জায়েনদেহ রুদ নদীর দক্ষিণে তাদের বসতি স্থাপনের ফলে সাফাভি শাসন আমস্টারডাম থেকে কলকাতা, মানিলা এবং ভেনিস পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের অংশীদার হয়। তারা রেশম বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং ওসমানীয়দের মাধ্যমে মধ্যস্থতা ছাড়াই ইউরোপ ও ইরানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল।

ইসফাহানের জুলফা সড়ক

দ্রুতই নিউ জুলফা এশিয়ার একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আর্মেনিয়দের ভূমিকা শুধু বাণিজ্যই নয়; তারা সাফাভি শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশি আদালতে কাজ করত এবং সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সেতুবন্ধন গড়ে তুলেছিল। বাণিজ্য থেকে অর্জিত ধন ধনশালী বাগানবাড়ি, মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ এবং ঐতিহ্যবাহী গির্জার নির্মাণে পরিলক্ষিত হয়।

এই এলাকার সবচেয়ে পরিচিত গির্জা হলো ‘ভাঙ্ক গির্জা’, যা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি নির্মিত হয়েছিল। এটি আর্মেনিয় স্থাপত্য এবং সাফাভি শৈলীর মিশ্রণ; বাহ্যিকভাবে সরল হলেও, ভেতরে বাইবেলের দৃশ্য এবং ইরানি চিত্রকলায় সমৃদ্ধ দেয়ালচিত্র রয়েছে।

ভাঙ্ক গির্জার মিউজিয়ামে মূল্যবান পাণ্ডুলিপি, ধর্মীয় পাত্র, পুরোহিতের পোশাক এবং ঐতিহাসিক দলিল সংরক্ষিত আছে। ১৬৩৬ সালে নিউ জুলফায় আনা ইরানের প্রাচীনতম মুদ্রণযন্ত্রের একটি সেটও এখানে রয়েছে। এছাড়াও, ১৯৭০-এর দশকে গির্জার প্রাঙ্গণে আর্মেনিয় গণহত্যার স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, যা ১৯১৫ সালের ওসমানীয় হত্যাকাণ্ডের শিকারদের স্মরণ করে।

ভাঙ্ক গির্জা

ভাঙ্ক গির্জার পাশাপাশি নিউ জুলফায় আরও ১২টিরও বেশি গির্জা রয়েছে, প্রতিটির নিজস্ব স্মৃতি ও শিল্পকলা বহন করে; মারিয়ম মোকাদ্দাস গির্জার সূক্ষ্ম চিত্রকলা থেকে শুরু করে বেথেলহাম গির্জার ৭২টি উজ্জ্বল দেওয়ালচিত্র পর্যন্ত।

সেইসময়ে, ইরানে আর্মেনিয়দের ধর্মীয় স্বাধীনতা অনন্য ছিল। তারা মুসলিম দেশের মধ্যে বসবাস করেও স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করত এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠান রক্ষা করত। ইস্ফাহানের মুসলিম ও আর্মেনিয়দের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কেবল অতীতে নয়, আজও অব্যাহত আছে।

ইস্ফাহানের মুসলিমদের কাছে নিউ জুলফা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তাদের শহর সবসময় সভ্যতার মিলনের স্থান ছিল, যেখানে আজানের আওয়াজ এবং গির্জার ঘণ্টাধ্বনি একসাথে শোনা যায়।

বিশ শতকে অনেক আর্মেনিয় প্রবাস গিয়েও নিউ জুলফা এখনও পশ্চিম এশিয়ার আর্মেনিয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর অন্যতম। আজকের নিউ জুলফা তার পুরোনো বাড়িগুলো পুনর্নির্মাণ করে কফি শপ ও রেস্টুরেন্টের জন্য পরিচিত। পাথরের রাস্তাগুলো এমন কফি শপগুলোতে পৌঁছে যায় যেখানে আর্মেনিয় কফির সুগন্ধ ছড়ায় এবং দোকানগুলোতে রৌপ্য ক্রস, কার্পেট ও শিল্পকলা বিক্রি হয়।

এই পরিবেশ পর্যটক ও স্থানীয় উভয়ের জন্যই আকর্ষণীয়, যা ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সঙ্গে আধুনিক সামাজিক জীবন উপস্থাপন করে। মুসলিম ও আর্মেনিয়রা এখনও একসঙ্গে বসবাস করছে, এবং আর্মেনিয়রা তাদের স্কুল, গ্রন্থাগার ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বজায় রেখেছে। বড়দিন ও ইস্টার উৎসব মহত্বরূপে উদযাপিত হয়, যেখানে মুসলিমরাও ঐক্যবদ্ধ মনোভাব নিয়ে অংশ নেয়।

নিউ জুলফার বাণিজ্য ইতিহাস, গির্জা, মিউজিয়াম এবং দৈনন্দিন জীবন দেখায় কিভাবে মানুষ তাদের পরিচয় রক্ষা করে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে এবং এই ঐতিহ্য এখনও জীবন্ত রয়েছে।#

পার্সটুডে/এমএআর/২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।