ইস্ফাহানের মিনার: বিশ্বাস, শিল্প আর ভূমিকম্প-সহনশীলতার এক অপূর্ব সমন্বয়
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i152198-ইস্ফাহানের_মিনার_বিশ্বাস_শিল্প_আর_ভূমিকম্প_সহনশীলতার_এক_অপূর্ব_সমন্বয়
পার্সটুডে: ঐতিহাসিক স্থাপত্যে মিনারগুলোকে বাতাস টাওয়ার, সুউচ্চ প্রবেশদ্বার আর শহরের প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কিন্তু এগুলো স্থাপত্যগতভাবে সবচেয়ে নাজুক কাঠামোগুলোর মধ্যে অন্যতম।
(last modified 2025-09-22T06:25:24+00:00 )
সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫ ১৯:৪৩ Asia/Dhaka
  • ইস্ফাহানের মিনার: বিশ্বাস, শিল্প আর ভূমিকম্প-সহনশীলতার এক অপূর্ব সমন্বয়

পার্সটুডে: ঐতিহাসিক স্থাপত্যে মিনারগুলোকে বাতাস টাওয়ার, সুউচ্চ প্রবেশদ্বার আর শহরের প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। কিন্তু এগুলো স্থাপত্যগতভাবে সবচেয়ে নাজুক কাঠামোগুলোর মধ্যে অন্যতম।

প্রেস টিভি'র প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইরান বহু শতাব্দী ধরে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হওয়ায়, স্থপতিরা অতিরিক্ত উচ্চতা এড়িয়ে গেছেন, বিশেষত সরু ও উঁচু টাওয়ার নির্মাণে। তবে ইস্ফাহান শহর ও আশপাশের এলাকা নিকটতম সক্রিয় ভূমিকম্প রেখা (যেমন জাগরোস ও কাশান ফল্ট) থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকায় ইতিহাসে কখনো বিধ্বংসী ভূমিকম্পের মুখোমুখি হয়নি। এই তুলনামূলক নিরাপদ ভূমিকম্প অঞ্চল, যা ইয়াজদ ও কেরমানের কিছু অংশও অন্তর্ভুক্ত করে, এখানকার স্থাপত্যে ব্যতিক্রমী উচ্চতার মিনার তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে।

পুরোনো সময়ে, ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে মিনারের ছাদের নিচে ঘণ্টা ঝোলানো থাকত—যা ভূমিকম্প সতর্কতার কাজ করত।

আলী মিনারের উচ্চতা ৪৮ মিটার

ইস্ফাহানের রেকর্ডধারী মিনার

ইস্ফাহান শহরের সবচেয়ে উঁচু স্বাধীন মিনার হলো সেলজুক আমলের (১২শ শতাব্দী) 'আলী মিনার' ও 'সারবান মিনার', যেগুলোর উচ্চতা প্রায় ৪৮ মিটার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সময়ের সঙ্গে উপরের অংশ ক্ষয়ে গেছে, মূলত এদের উচ্চতা ছিল ৫০ মিটারেরও বেশি।

ইস্ফাহানের উপকণ্ঠে 'জিয়ার মিনার' (৫০ মিটার) ও কাশানের 'জাইনউদ্দিন মিনার' (মূলত ৪৭ মিটার, ১৯২৩ সালে ধসে ২২ মিটারে নেমে আসে) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ইস্ফাহানের 'ইমাম মসজিদের মিনার' ৫২ মিটার উচ্চতা নিয়ে আরও উঁচু, তবে এগুলো স্বতন্ত্র নয়, বরং ইওয়ানের উপর নির্মিত। একইভাবে ইয়াজদের জামে মসজিদের মিনারও ৫২ মিটার উঁচু।

আরও উল্লেখযোগ্য স্বাধীন মিনার হলো ইলখানি আমলের 'বাগ-এ কুশখানে মিনার' (৩৮ মিটার), সেলজুক আমলের 'চেহেল দোখতারান মিনার' (২৪ মিটার), শহরের কাছে 'রাহরোভান মিনার' (৩০ মিটার) ও 'বারসিয়ান মিনার' (৩৪ মিটার)।

সুউচ্চ প্রবেশ দ্বারের উপর দাঁড়ানো যুগল মিনারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সাফাভি আমলের 'চাহারবাগ মাদ্রাসা মিনার' (৩৮ মিটার), ইলখানি আমলের 'দার-আল-জিয়াফা মিনার', এবং 'দারদাশত ও সাফাভি জামে মসজিদের যুগল মিনার'।

আশ্চর্যের বিষয়, সাফাভি ও কাজার আমলের কিছু মসজিদে কোনো মিনারই নেই—যেমন শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ, আলী কুলি আগা মসজিদ, হাকিম মসজিদ, মোহাম্মদ জাফর আবাদী মসজিদ প্রভৃতি।

বর্তমানে ইস্ফাহানের সবচেয়ে উঁচু মিনার হলো ইমাম খোমেনি মোসাল্লার দক্ষিণের 'যুগল মিনার', যেগুলোর উচ্চতা ১১০ মিটার। এগুলো দেশের দ্বিতীয় উঁচু মিনার, তেহরানের মোসাল্লার ১৩৫ মিটার উচ্চতার মিনারের পরেই অবস্থান করছে।

গোনবদ-এ কাবুস টাওয়ার

জাতীয় ও আঞ্চলিক তুলনা

ইস্ফাহানের সবচেয়ে উঁচু মিনারগুলো সম্ভবত প্রাক-আধুনিক ইরানি স্থাপত্যের সর্বোচ্চ কাঠামো। গোলেস্তান প্রদেশের 'গোনবদ-এ কাবুস টাওয়ার' (৫২.০৭ মিটার) প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইটের টাওয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যদিও এর উচ্চতায় কৃত্রিম টিলা অন্তর্ভুক্ত।

ইমাম মসজিদের গম্বুজের উচ্চতা (৫৪ মিটার) গোনবদ-এ কাবুস টাওয়ারের চেয়েও বেশি। ফলে ধারণা করা হয়, আলী মিনার ও সারবান মিনার আসল অবস্থায় হয়তো এর চেয়েও উঁচু ছিল।

ভূমিকম্প-সংবেদনশীলতার কারণে ইরানি মিনার সাধারণত প্রতিবেশী অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা ছোট। যেমন—মরক্কোর 'কুতুবিয়া মিনার' (৭৭ মিটার), ভারতের 'কুতুব মিনার' (৭২ মিটার), ইস্তাম্বুলের 'সোলায়মানিয়া মসজিদের মিনার' (৭৬ মিটার), আফগানিস্তানের 'জাম মিনার' (৬৫ মিটার), এবং মধ্য এশিয়ার 'কুতলুগ তিমুর মিনার' (৬০ মিটার)।

ইরানের মিনারগুলো সাধারণত ছোট গম্বুজযুক্ত শীর্ষে নির্মিত হয়, অন্যদিকে অটোমান মিনারগুলোর ধারালো, শঙ্কুযুক্ত শীর্ষ থাকে যা কখনও কখনও কাঠামোর উচ্চতা ১২ মিটার পর্যন্ত বাড়ায়। এই কারণে, ইস্ফাহানের মিনারগুলো তাদের নলাকার উচ্চতার দিক থেকে ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদের (৬৪ মিটার) সাথে তুলনীয়।

জুম্বন মসজিদের যুগল মিনার

বিখ্যাত 'কম্পনশীল মিনার'

১৪শ শতকে ইরানের ইস্ফাহান প্রদেশে এক অনন্য স্থাপত্য ঘটনা দেখা যায় যা ‘কম্পনশীল মিনার’ নামে পরিচিত। মূল উদাহরণটি ইমানশহরের জামে মসজিদে থাকলেও হারিয়ে গেছে। তবে ইস্ফাহানের 'জুম্বন মসজিদের যুগল মিনার' আজও পর্যটকদের বিস্মিত করে।

এই মিনার যুগল একই সঙ্গে স্বতন্ত্র হলেও কাঠামোগতভাবে এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যে, একটিকে নড়ালে অন্যটিও কেঁপে ওঠে।

এই অভিনব প্রযুক্তি ১৫শ শতকে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আহমেদাবাদের 'সিদি বশির মসজিদ' এখনও এর উদাহরণ দেখা যায়। তবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে 'রাজ বিবি মসজিদের কম্পনশীল মিনার' ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য

ইস্ফাহানের মিনারগুলো উচ্চতা-প্রস্থের একটি নির্দিষ্ট অনুপাত অনুসরণ করে নির্মিত, যা প্রাচীন ইরানি স্থাপত্যশাস্ত্রে বর্ণিত।

ভূমিকম্প প্রতিরোধে ব্যবহার করা হতো নমনীয় ইটের গাঁথুনি ও ক্রমশ সরু হওয়া শীর্ষাকৃতি নকশা। অনেক মিনারের ভেতরে কাঠের শক্তিবৃদ্ধি রিং বসানো হতো।

অভ্যন্তরে সাধারণত একটি কেন্দ্রীয় স্তম্ভ ঘিরে পাক খেয়ে ওঠা সিঁড়ি থাকত, যা স্থিতিশীলতা বাড়াত। সিঁড়িগুলো নিখুঁত গাণিতিক হিসাব অনুযায়ী নকশা করা হতো। কিছু মিনারে আর্দ্রতা রোধে বায়ুচলাচলের ব্যবস্থাও ছিল।

উপরের দিকে যেতে যেতে দেয়ালের পুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে আসত। অনেক মিনারে ওপরের দিকে পর্যবেক্ষণ কক্ষ, দর্শন-বারান্দা ও ধ্বনিবর্ধক নকশার ফাঁপা চেম্বার থাকত। কিছু মিনারের শীর্ষে লুকানো টাইম ক্যাপসুলে মুদ্রা ও দলিল রাখা থাকত।

স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য

মিনার শুধু আজানের জন্য নয়, বরং শহরের চিহ্ন, প্রহরীদুর্গ ও রাজনৈতিক শক্তির প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

ইস্ফাহানের প্রাচীনতম আলি ও সারবান মিনার সরু নলাকার, জটিল ইটশিল্প ও কুফি লিপি খোদাইয়ে সজ্জিত। সেলজুক আমলের মিনারগুলোতে জ্যামিতিক নকশা, হাজারবাফ ইটশিল্প ও পরে রঙিন টাইলের সংমিশ্রণ দেখা যায়।

সূর্যালোক ইটের অলঙ্কারে পড়লে তৈরি হতো আলো-ছায়ার অনন্য খেলা। সাফাভি আমলে উষ্ণ ইটের রঙ জায়গা করে দেয় ফিরোজা সবুজ, লাজওয়ার্দি নীল আর সোনালি টাইলের ঝলককে।

'চেহেল দোখতারান মিনার' ছিল প্রাচীনতম গ্লেজড টাইলের উদাহরণগুলোর একটি। 'দারদাশত মিনার' সেলজুক ইটশিল্প থেকে ইলখানি টাইল অলঙ্করণে উত্তরণের নমুনা দেখা যায়।

অনেক মিনারে বিভিন্ন সময়ের নির্মাণশৈলী মিশ্রিত। গোলাকার ভিত্তি থেকে বহুভুজে রূপান্তরও স্থাপত্য-রূপান্তরের প্রমাণ।

মিনারের বারান্দাগুলো সাধারণত মুকারনাস (মিনারাকৃতি নকশা)-এর উপর ভর করে নির্মিত, যা একই সঙ্গে কাঠামোগত ও অলঙ্কারিক।

অলঙ্করণে সাধারণত কুরআনের আয়াত, নির্মাণ সাল ও দাতার নাম খোদাই করা থাকত। সাফাভি আমলে অনেক মিনারে ১২টি খোপ বা ৪০টি সিঁড়ির মতো প্রতীকী সংখ্যা ব্যবহার করা হতো, যা শিয়া মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতীক।

২০শ শতকের পুনঃস্থাপনে এসব মিনারের আসল রঙ ও নির্মাণপ্রযুক্তি প্রকাশিত হয়। আজও ইস্ফাহানের মিনারগুলোর নিখুঁত জ্যামিতিক অনুপাত বিশ্বজুড়ে স্থপতিদের অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছে।#

পার্সটুডে/এমএআর/২১