ভেনেজুয়েলায় হামলা কি লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপকামী নীতিতে ফেরার ইঙ্গিত?
-
সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম
পার্সটুডে: রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের ফাঁস করা বক্তব্য অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে সীমিত সামরিক অভিযানের কথা বলেছেন, যা লাতিন আমেরিকায় মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রত্যাবর্তনের সতর্কবার্তা বাজিয়ে দিয়েছে।
সিনেটর গ্রাহাম ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, ট্রাম্প রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের এক বৈঠকে 'ভেনেজুয়েলা এমনকি কলম্বিয়ার বিরুদ্ধেও সীমিত সামরিক অভিযান' চালানোর সম্ভাবনার কথা বলেন।
সামরিক প্রস্তুতি ও পুরোনো স্মৃতি
ভেনেজুয়েলায় হামলার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আবারও মনে পড়ছে ওয়াশিংটনের দীর্ঘ ইতিহাসের হস্তক্ষেপগুলো। গ্রাহাম বলেন, ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সময় এসে গেছে।”
ক্যারিবিয় সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোকে 'মাদক কার্টেলবিরোধী অভিযান'-এর অজুহাতে মোতায়েন করা হয়েছে, কিন্তু অ্যাক্সিওস ওয়েবসাইটের তথ্যানুসারে, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো- 'কারাকাসের ওপর সামরিক চাপ বাড়ানো'। বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ লাতিন আমেরিকায় মার্কিন হস্তক্ষেপনীতির নতুন অধ্যায় সূচিত করতে পারে।
মনরো ডকট্রিনের ছায়া
নিউজউইক লিখেছে: "ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলাবিরোধী ক্রমবর্ধমান হুমকি এবং ক্যারিবিয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ হামলা, মার্কিন হস্তক্ষেপনীতির পুনরুজ্জীবন নির্দেশ করে, যার শিকড় মনরো ডকট্রিনে প্রোথিত।”
১৯শ শতকে প্রণীত 'মনরো ডকট্রিন' ইউরোপীয় শক্তিগুলোর প্রভাব ঠেকাতে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে ওঠে লাতিন আমেরিকার ওপর ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণের ন্যায্যতা দেওয়ার হাতিয়ার।
পানামাকে কলম্বিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার হস্তক্ষেপ, পানামা খালের আশপাশের দেশগুলো দখল এবং চিলি ও ব্রাজিলে জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন- এসবই সেই দীর্ঘ তালিকার অংশ।
শীতল যুদ্ধ থেকে নরিয়াগা পর্যন্ত
শীতল যুদ্ধের পর ওয়াশিংটনের লক্ষ্য 'ইউরোপ-বিরোধিতা' থেকে 'সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দমন'-এর দিকে সরিয়ে নেয়।
১৯৭৩ সালে চিলির অভ্যুত্থান সমর্থন এবং আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়েতে 'অপারেশন কন্ডর'-কে সমর্থন দেখিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক একনায়কদের সমর্থন ও জনবান্ধব সরকার উৎখাতের মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকেও হস্তক্ষেপের এই ধারা অব্যাহত থাকে।
১৯৮৯ সালে জেনারেল ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে উৎখাতের জন্য মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে পানামায় সরাসরি আক্রমণ ছিল এই হস্তক্ষেপগুলোর চূড়ান্ত উদাহরণ।
ওয়াশিংটন সেই অভিযানকে 'দ্রুত সাফল্য' হিসেবে প্রচার করলেও বাস্তবে এর ফল ছিল শত শত বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু, বস্তি ধ্বংস এবং দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতা।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ডেনিস এম. হোগান-এর বিশ্লেষণ উদ্ধৃত করে জানিয়েছে: "ওয়াশিংটন যেন না ভাবে, ১৯৮৯ সালে পানামায় যা করেছিল, তা ভেনেজুয়েলায় পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব।”
তার মতে, এই দুটি দেশের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য, যেমন আয়তন ও জনসংখ্যা থেকে সামরিক সক্ষমতা ও শক্তি সম্পদ, এই ধরনের পরিস্থিতিকে ব্যয়বহুল ও অনিশ্চিত পরিণতি বয়ে আনবে।
হোগান আরও বলেন, “যা বাহ্যত মাদকবিরোধী অভিযান হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে, বাস্তবে তা কারাকাসে শাসন পরিবর্তনের এক রাজনৈতিক প্রচারণা।” তাঁর মতে, এর উদ্দেশ্য নিরাপত্তা নয়, বরং রাজনৈতিক ও প্রচারমূলক— যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে দৃষ্টি সরানো এবং দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন অর্জন।
সম্ভাব্য বিপর্যয়ের সতর্কতা
স্টিমসন সেন্টারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনও এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। সেখানে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ 'অঞ্চলে আরও অস্থিতিশীলতা, মাদক পাচার বৃদ্ধি এবং নতুন অভিবাসন সংকট' সৃষ্টি করবে।
এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রে রয়েছেন রিপাবলিকান কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি বহুদিন ধরেই কারাকাসে শাসন পরিবর্তনের সমর্থক, আর এখন কূটনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে 'পশ্চিম গোলার্ধের নতুন শৃঙ্খলা' তৈরি করতে চাইছেন।
রুবিও কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে ঘোষণা করেছেন: "সমাজতান্ত্রিক একনায়কদের প্রতি সহনশীলতার নীতি শেষ হয়েছে।”
তবে উভয় দলের কিছু আইনপ্রণেতা এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, প্রেসিডেন্ট কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়া নতুন কোনো যুদ্ধে জড়াতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রদূত 'সামুয়েল মঙ্কাদা' নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো এক চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন যে, তারা "আন্তর্জাতিক জলসীমায় ২৭ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে।” তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন, যেন তারা “রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার নীতিকে” সম্মান করার বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
অনেক গবেষক মনে করেন, ট্রাম্প ও রুবিও'র বর্তমান নীতি হলো আক্রমণাত্মক “রুজভেল্ট ডকট্রিন”-এর ধারাবাহিকতা। ইতিহাসবিদ গ্রেগ গ্র্যান্ডিন লিখেছেন: "ওয়াশিংটন কখনোই লাতিন আমেরিকায় হস্তক্ষেপ বন্ধ করেনি— এমনকি তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী সময়গুলোতেও নয়; হন্ডুরাস থেকে নিকারাগুয়া, ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত মার্কিন সেনাদের পদচিহ্ন সর্বত্রই রয়ে গেছে।”
আজ ক্যারিবিয়ান সাগরে যা ঘটছে, তা সেই পুরোনো ছকই পুনরায় মঞ্চস্থ করছে— জাতীয় নিরাপত্তার নামে সামরিক হস্তক্ষেপ, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য 'ভূরাজনৈতিক ও নির্বাচনী'।
হার্ভার্ডের অধ্যাপক হোগানের মতে, এমন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো স্থায়ী সুফল বয়ে আনবে না; বরং কেবল রেখে যাবে 'যন্ত্রণা, অস্থিতিশীলতা ও ক্ষোভের উত্তরাধিকার'।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে- প্রতিবার ওয়াশিংটন যখন স্বাধীনতার নামে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে, ফলাফল হয়েছে কেবল ধ্বংস আর ঘৃণা।#
পার্সটুডে/এমএএআর/২৮