স্বাস্থ্যকথা: হৃদরোগ-পর্ব ২
হোটেলে ভাজাভুজির তেল হার্টের জন্য বিষ
হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক এক নীরব ঘাতক। যেকোনো সময় যে কেউ হার্ট অ্যাটাকের শিকার হতে পারেন। ব্যয়াম না করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণ না করা এবং জীবনযাপনে অনিয়ম হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে থাকে। হোটেলে ভাজাভুজির তেল এড়িয়ে চলতে হবে। সামুদ্রিক মাছের তেল এবং উদ্ভিজ তেল হার্টের জন্য খুবই উপকারী। যতটা সম্ভব এসব তেল খাওয়ার চেষ্টা করব।
শ্রোতাবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশাকরছি সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। আমরা হৃদরোগ বা হার্টডিজেজ নিয়ে আজ দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় যাব। এ বিষয়ে কথা বলবেন বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.মোহা. তাইফুর রহমান। এই চিকিৎসক কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
ডা. মো. তাইফুর রহমান রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: ডা.মো.তাইফুর রহমান প্রথম পর্বের আলোচনায় আপনি হার্টে ব্লকের কথা বলছিলেন, একইসাথে বলেছিলেন এটি প্রায় ঘরে ঘরেই আছে। আর হার্টে ব্লক আছে কিন্তু ধরা যাচ্ছে না কিংবা বোঝা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে করণীয় কি এবং এটি হওয়ার কারণগুলোও নিয়ে কথা বলছিলেন। ব্লক হলে ব্যথা হতে পারে। তো হৃদরোগের কারণগুলো সম্পর্কে যদি আলোচনা করেন ?
ডা. মো. তাইফুর রহমান: হার্টে ব্লক থাকলে ব্যথাটা হবে এরকম যে, বিশ্রাম নিলে কমে যায় আর পরিশ্রম করলে, সিঁড়ি ভাঙলে এমনকি খাওয়ার পর হাঁটতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায়। এটাকে আমরা বলি হৃদরোগের ক্রিটিকাল একটা ব্যথা। এটা থাকলে আমরা হৃদরোগের চিন্তাটা খুব বেশি করি। প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যথা কখন হবে আর কখন ছাড়ে? দেখুন রক্তনালীগুলোর যতটা ক্যালিবার আছে- আমাদের মহান আল্লাহতায়ালা তা এমনভাবে তৈরি করেছেন হার্টে স্বাভাবিকভাবে যতটুকু রক্ত দরকার তা যাওয়ার মতো এর চারগুণ রক্তনালী তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। সুতরাং এই রক্তনালীতে চর্বি জমতে জমতে যতক্ষণ না ৭০ শতাংশের ওপরে ব্লক না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু অনেকে বুঝতেই পারে না। এতে স্বাভাবিক হাঁটা চলায় তার কোনো ব্যথা হবে না। কিন্তু সে যখন পরিশ্রমের কাজ করবে তখন বুকটা চেপে আসবে। এটি হার্টে ব্লকের প্রাথমিক লক্ষণ। আর যখন তার হার্ট অ্যাটাক হয়েই যাবে অর্থাৎ শতভাগ ব্লক হলেই তখন তাকে হার্ট অ্যাটাক বলে। আর ঐ সময় তারা হাঁটা চলা ফেরার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই সব সময়ই ব্যথা হয়। বুকটা চেপে আসবে, ঘাম হবে এবং বমি বমি ভাব হবে। সে মৃত্যু ভয়ে ভীত হবে। আর এইসব সিমটম যখন দেখা যাবে তখন সেটাকে আমরা হৃদরোগ হিসেবে ডায়াগনসিস করব।
রেডিও তেহরান: ডা.তাইফুর রহমান আপনার আলোচনা থেকে হৃদরোগের কারণগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পেলাম। এবার যদি আপনি করণীয় সম্পর্কে সহজ করে আমাদের শ্রোতাদের জানান?
ডা.মো. তাইফুর রহমান: করণীয়'র প্রথম কথা হচ্ছে এরকম হলে অবশ্যই রোগীকে হাসপতালে নিতে হবে। সেখানে নিয়ে আগেই একটা ইসিজি করাতে হবে। ইসিজি করানোর আগ পর্যন্ত কিন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে হৃদরোগ হয়েছে। তবে ধরুন এ রকম পরিস্থিতি হলো কিন্তু আমি কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে আছি বা দূরের কোনো জায়গায় আছি সেখান থেকে হাসপাতল অনেকটা দূর। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে যে ৭৫ মিলিগ্রামের অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট পৃথিবীতে এটি ৮১ মিলিগ্রাম হিসেবে পাওয়া যায়- এই অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট ৫ টা একসাথে খেয়ে ফেলতে পারি এর সাথে ( ওতিরোজেল ট্যাবলেট) তাহলে রক্ত জমাটা বাঁধাটা কমে যায়। এটাকে লোরিং ডোজ বলা হয়। অবশ্যই চারটা যোগ চারটা মোট আটটা ট্যাবলেট খাওয়া উচিত। পরে যদি দেখা যায় হৃদরোগ ছিল না বা হ্যার্ট অ্যাটাক ছিল না তাতেও কিন্তু ক্ষতি নেই। কিন্তু যদি হার্ট অ্যাটাক হয় এবং দেরি করে ফেলা হয় তাহলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। এখানে মনে রাখতে হবে হার্টঅ্যাটাকে প্রতিটি মুহূর্ত হচ্ছে 'মাসেল'। প্রতিটি মুহূর্তে মাসেলগুলো ড্যামেজ হচ্ছে। সুতরাং এই মাসেল ড্যামেজ থেকে বাঁচতে হলে যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায় তত ভালো।
রেডিও তেহরান: হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোও খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন। তো হৃদরোগের কারণের মধ্যে কোলেস্টোরেল একটি অন্যতম বিষয়। এ নিয়ে আপনি কিছু কি বলবেন?
ডা.মো.তাইফুর রহমান: জ্বি আমরা সবাই কিন্তু কোলেস্টোরেলের ব্যাপারে খুবই কনসার্ন। কোনটাতে কোলেস্টোরেল বেশি কোনটাতে কম সেটা নিয়ে ইদানিং খুব বেশি আলোচনা শুনি। কোন তেল ভালো। সরিষা নাকি সয়াবিন নাকি সূর্যমুখীর তেল খাব এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত থাকি। এখানে আমি শুরুতে খুব মোটাদাগে বলব যে তেল ঠান্ডায় জমে যায় সে তেল শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আর যে তেল ঠান্ডায় জমে না সেসব তেল হার্টের জন্য ভালো।
দেখা যায় প্রাণীজ চর্বি প্রায় সবগুলোই কিন্তু ঠান্ডায় জমে যায়। সেগুলো কিন্তু হার্টের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে উদ্ভিজ তেল (কেবলমাত্র পামওয়েল ও নারিকেল তেল ছাড়া) হার্টের জন্য ভালো। এখন যদি বৈজ্ঞানিক আলোচনায় যাই তাহলে সেচ্যুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা কিছু আছে তার সবগুলো হার্টের জন্য ক্ষতিকর। আর আন সেচ্যুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যেগুলো আছে সেগুলো শরীরের জন্য ভালো। কারণ আনসেচ্যুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আমাদের হার্ট থেকে চবিগুলো বের নিয়ে আসে এবং লিভারে এসে সেটি মেটাবোলাইজ করে। মানে এটাকে ধ্বংক করে ফেলে বা গলিয়ে ফেলে। আর অনসেচ্যুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আছে সামুদ্রিক মাছের তেলে। এটি আছে বাদাম বা বাদাম জাতীয় জিনিস কিংবা ডালে। একটা গবেষণায় দেখা গেছে আলাস্কার মানুষরা অনেক মোটা থলথলে। কিন্তু তাদের হার্টের রোগ নেই। দেখা গেছে তারা শিমের তেল খায়। আর সে কারণে তাদের হার্টে কোনো ব্লক তৈরি হয় না। সুতরাং আমাদের যেটি করণীয় সেটি হচ্ছে প্রথমত আমাদের উদ্ভিজ তেলের দিকে নজর দিতে হবে। প্রাণীজ চর্বিকে এড়িয়ে চলব এবং সামুদ্রিক মাছের তেল যদি খেতে পারি; সেটি খাব।
রেডিও তেহরান: ডা.তাইফুর রহমান, চর্বিতে ক্ষতির কথা বলছিলেন। কোন তেল খাওয়া যাবে এবং কোনটা খাওয়া ক্ষতি হবে সে বিষয়ে বলছিলেন। তো তেলের ভেতর বেশি ক্ষতি কোনটাতে?
ডা. মো. তাইফুর রহমান: তেলের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে কোন্ তেলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বলি- হোটেলে রান্নার তেল। মানে হচ্ছে হোটেল শুরু হওয়ার দিন থেকে যে তেল দিয়ে সিঙ্গাড়া বা শমোচা ভাজা শুরু হয় সেটি কিন্তু চলতে থাকে মাসের পর মাস। একটু তেল থেকে যায় পরের দিন আবার তাতে তেল মেশানো হয়। এই যে বারে বারে হাইটেম্পারেচারে গরম গরম হতে হতে আনসেচ্যুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড একসময় সেচ্যুরেটেড হয় তারপর এটি থেকে টেলি সেচ্যুরেটেড মানে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়। এই ট্রান্সফ্যাট অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি হার্টে যাওয়ার সাথে সাথে দুয়ে দুয়ে চার না হয়ে দুয়ে দুয়ে ছয় হয়ে যায়। তারপর ইনফ্লামেশন বা দহন হয়। এরপর যতটা রক্তনালী যতটা ভরাট হওয়ার কথা ছিল তার দ্বিগুণ তিনগুণ ভরাট হয়ে যায়। আর তখন অতি দ্রুত রক্তনালী ব্লক হয়ে যায়। সুতরাং আমাদের হোটেল রেস্টুরেন্টের এই তেল খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
জনাব,ডা.তাইফুর রহমান হৃদরোগ নিয়ে সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শ্রোতাবন্ধুরা! এতক্ষণ হৃদরোগ নিয়ে আলোচনা শুনছিলেন। হৃদরোগের ঝুঁকি মুক্ত থাকতে অবশ্য তৈলাক্ত এবং চর্বি জাতীয় খাবার কম খাবেন। নিয়মিত ব্যায়াম করবেন।
তো এরইসাথে গুটিয়ে নিচ্ছি স্বাস্থ্যকথার আজকের আসর। আগামী আসরেও হৃদরোগ নিয়ে আলোচনা হবে। তখনও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না। সবাই ভালো সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৫