রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-১০)
দুঃখী জনের দুঃখ বুঝতে/রোজা হলো ফরজ, সাম্য মৈত্রী শেখার সবক নেয়া এই মাসেই সহজ।
আত্মশুদ্ধির জন্য মহামানব ও মহামানবীদের জীবনী বেশি বেশি অধ্যয়ন বা তাদের কথা ও কাজগুলোর অনুসরণ জরুরি। তাঁদের মহতী গুণগুলো যুগে যুগে মানুষকে সত্যের পথে ত্যাগী হওয়ার প্রেরণা যোগায়। আত্মত্যাগ ও দানশীলতার ইতিহাসে উম্মুল মু'মিনিন হযরত খাদিযার (সা) রয়েছে শীর্ষস্থানীয় অবস্থান।

তিনি তাঁর যুগে আরবের সবচেয়ে ধনী হয়েও দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য এবং ইসলামের জন্য তাঁর সর্বস্ব দান করেছিলেন। দশই রমজান তাঁর ওফাত-দিবস। তাঁর জন্ম হয়েছিল মক্কায়। পিতা ছিলেন খুয়াইলিদ বিন আসাদ। খুয়াইলিদ ছিলেন কুরাইশ গোত্রের একজন ধনী ব্যবসায়ী। /কুরাইশরা ব্যবসাকে খুব গুরুত্ব দিত। অন্য আরব গোত্রের বেশিরভাগ মানুষ বছরে একবার বাণিজ্য ভ্রমণে বের হলেও কুরাইশরা বছরে দুইবার বাণিজ্য ভ্রমণে বের হত। সুরা কুরাইশে মহান আল্লাহ কুরাইশদের নিরাপত্তার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তারা শীতকালে নিরাপদে ইয়েমেনে ও গ্রীস্মকালে সিরিয়ায় সফর করতে পারত। আবরাহার হস্তি বাহিনীর মোকাবেলায় মহান আল্লাহ কুরাইশদেরকে রক্ষা করেছিলেন।
হযরত খাদিযার মাতা মহানবীর-সা. জন্মের ৫ বছর পর মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়। আরো দশ বছর পর মারা যান তাঁর বাবা। বাবার মৃত্যুর পর খাদিযা তাঁর পিতার সম্পদের উত্তরাধিকারী হন ও বাবার ব্যবসা অব্যাহত রাখার দায়িত্ব পালন করেন এবং তা আরো বেশি সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হন। মহানবীর সঙ্গে বিয়ের আগেও খাদিযা তাঁর সম্পদ ইয়াতিম, অক্ষম, দুর্বল ও দরিদ্রদের জন্য ব্যয় করতেন। দরিদ্র ও নিঃস্ব মেয়েদের বিয়ের খরচও তিনি দিতেন। হযরত খাদিযার পরিবার ইসলাম পূর্ব যুগেও একত্ববাদী ছিলেন এবং তারাও হযরত ইব্রাহিমের ধর্ম বা দ্বীনে হানিফের অনুসারী ছিলেন মহানবীর দাদা ও পিতার মতই। মহানবীর চাচা আবু তালিবও ছিলেন অনুরূপ। চাচা আবুতালিব মহানবীর সুরক্ষায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হযরত খাদিযার অর্থে প্রতিপালিত হত মক্কার ইয়াতিম ও দরিদ্ররা। জাহিলি যুগে আরবরা যখন নারীকে সম্মান দিত না। স্ত্রীর প্রতি আচরণ যখন ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপমানজনক এবং আরবদের অনেকেই যখন কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত নারীর প্রতি সেই অসম্মানের যুগেও আরবরা হযরত খাদিযাকে দেখতো সম্মানের দৃষ্টিতে। তারা তাঁকে বলতো তাহেরা তথা পবিত্র। দানশীলতা ও মানুষের সঙ্গে সদাচারণের কারণে জনগণ তাকে বলত কুরাইশ রাজকন্যা!

হযরত খাদিযাকে স্মরণ করে মহানবী অশ্র-সজল হয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন: মানুষ যখন আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়েছিল তখন খাদিযাই সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি আমাকে সে সময় সহায়তা করেছেন ও সেবা করেছেন নিজেই এবং সাহায্য করেছেন অর্থ দিয়ে যখন কেউই আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি।
মহানবী (সা) হযরত খাদিযাকে বিয়ে করেন নিজের ২৫ বছর বয়সে। সে সময় হযরত খাদিযার বয়স ছিল ৪০ বা মতান্তরে ২৮। বলা হয় ইসলাম প্রচারের কাজে ও ইসলামের প্রাথমিক যুগে কঠোর-নিষেধাজ্ঞা কবলিত মুসলমানদের সেবায় সমস্ত সম্পদ ব্যয় করেন হযরত খাদিযা (সা)। ফলে নিজ কন্যা ফাতিমার জন্য তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদই রেখে যেতে পারেননি।
শেবে আবু তালিবে অবরুদ্ধ মুসলমানদের সঙ্গে যখন কথা বলা, লেনদেন করা এবং এমনকি পানি ও খাদ্য সরবরাহ করাও নিষিদ্ধ করেছিল কাফের কুরাইশ নেতৃবৃন্দ সে সময় পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণের গৌরবের অধিকারী কিশোর আলী (আ) গোপনে ঝুঁকি নিয়ে মক্কায় যেতেন এবং এক মোষক পানি নিয়ে আসতেন। আর সেই পানির জন্য হযরত খাদিযার সম্পদ থেকে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করা হত। খাবারও আনা হত হযরত খাদিযার অর্থ দিয়ে।
খাদিযা সা. আ. ছিলেন সত্যিকার অর্থেই উম্মতের মাতা বা উম্মুল মু'মিনিন। মহান ফেরেশতা হযরত জিব্রাইল (আ) মহান আল্লাহর সালাম পৌঁছে দিতে হযরত খাদিযার কাছে। যখন কয়েক বছর পর শেবে আবু তালিবের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয় তখন হযরত খাদিযা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন শারীরিকভাবে। বলা হয় তার কাছে আর কোনো অর্থ-কড়িই ছিল না। এমনকি কাফন দেয়ার কাপড় কেনার সামর্থও ছিল না। তাই তিনি ওসিয়ত করেছিলেন যেন মহানবীর জামাকে তাঁর কাফন করা হয়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে হযরত খাদিযার জীবন থেকে দান ও আত্মত্যাগের গুরুত্ব বোঝার এবং তাঁর আদর্শের অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন।

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।