হিজরত পাপ-বর্জনের অন্যতম উপায়
রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-১৯)
পাপরাশি মুছে দিয়ে মুক্তির চেষ্টা/রোজাগুলো যেন মেটায় আত্মিক তেষ্টা। মন্দকে নাচাতে/আত্মাকে বাঁচাতে/রমজানে বেড়ে যাক ঈমানি বেশটা। (ইসলাম তরিক)
আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্যই মানুষ সৃষ্টি করে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ইবাদত দু’ধরনের। এর একটি হলো- হাক্কুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর হক। আর অপরটি হলো হাক্কুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হক। আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত অধিকার বা কর্তব্যকে হাক্কুল্লাহ বলে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য অনেক ধরনের ইবাদত করি। সেগুলোর মধ্যে কিছু ইবাদত শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য নির্দিষ্ট। যেমন- নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি।
আল্লাহর হক আদায়ের আগে প্রত্যেক মানুষকে অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করতে হবে তা হলো- আল্লাহ আছেন, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। তাঁর আদেশেই পৃথিবীর সবকিছু আবার ধ্বংস হবে। আমাদের জীবন-মৃত্যু সবই তাঁর হাতে। পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতাভুক্ত। তাঁর হাতেই সব সৃষ্টির রিজিক। আমরা তাঁরই ইবাদতকারী। তিনি ইবাদাত-উপাসনার উপযুক্ত আর কেউ নেই- এ সব কিছু মনে প্রাণে বিশ্বাস করা ও স্বীকার করাই হলো বান্দার ওপর আল্লাহর হক। অন্যদিকে মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়েই মানুষকে বসবাস করতে হয়। আমরা পিতামাতা ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে সামাজিকভাবে একসাথে বসবাস করি। একজনের দুঃখে অন্যজন সাড়া দিই। আপদে বিপদে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করি। পরস্পরের প্রতি এ সহানুভূতি দায়িত্বই হলো হাক্কুল ইবাদ অর্থাৎ বান্দার হক বা অধিকার। মানুষের প্রতি মানুষের হক বা অধিকারকে আটটি ভাগে ভাগ করা যায় যেমন (১) নিকটাত্মীয়ের হক, (২) দূরাত্মীয়ের হক, (৩) প্রতিবেশীর হক, (৪) দেশবাসীর হক, (৫) শাসক-শাসিতের হক, (৬) সাধারণ মানুষের হক, (৭) অভাবী লোকের হক এবং (৮) অমুসলিমদের হক।
প্রত্যেক মুসলমানের আল্লাহর হক পালন করার সাথে সাথে মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনেও সচেষ্ট হতে হবে। খোদাদত্ত আদর্শের আলোকে তথা ইসলামী শিক্ষার আলোকে আমরা ইয়াতিমের সেবা করে, অনাথ ও নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়ে, অশিক্ষিতকে শিক্ষিত করে বা পথহারাকে পথ দেখিয়ে, দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য দিয়ে, বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করে, ইসলামের নানা শিক্ষা ও মূল্যবোধকে ছড়িয়ে দিয়ে কিংবা জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ ইসলামী নানা দায়িত্ব পালন করে মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র হতে পারি। অথচ আমরা অনেকেই এইসব পথে চলার ব্যাপারে মহান আল্লাহর আহবানকে প্রত্যাখ্যান করছি। মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে আল্লাহর বন্ধুত্বের আহ্বানকে পদদলিত করছি! মহান আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন জ্ঞান, রুজি-রিজিক, দৈহিক শক্তি ও সুস্থ অঙ্গ-প্রতঙ্গসহ অসংখ্য নেয়ামত। অথচ আমরা আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহের জবাবে মৌখিক কৃতজ্ঞতাটুকুও প্রকাশ করছি না। বরং আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের বিরোধী পথে চলছি!

পবিত্র রমজান পাপ এড়ানোর চর্চা করা ও আত্মশুদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি খোদার প্রেমে বিভোর হওয়ার মাস। এ মাস বিশেষভাবে শবে কদর বা কদরের রাত মহান আল্লাহর প্রেমে আত্মহারা হওয়ার লগ্ন। তবে যারা অতি উচ্চ স্তরের খোদাপ্রেমিক তাদের জন্য জীবনের প্রতিটি রাতই যেন শবে কদর। খোদা-প্রেমের মধুর শরাব পিয়ে তারা মহান আল্লাহর দরবারে বেহুঁশ হয়ে থাকেন প্রত্যেক রাতেই। তাঁদের মুনাজাতে ফুটে উঠে আল্লাহর সামনে সর্বোচ্চ বিনয় ও ত্যাগের আকুতি। এমন কোনো মুহূর্ত নেই যখন তাঁদের মন আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকে। এমন কোনো ঘটনা বা দৃশ্য নেই যাতে তারা আল্লাহর উপস্থিতি বা নিদর্শনকে অনুভব করেন না।
কুফার মসজিদে আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র উচ্চারিত কান্নাসিক্ত দোয়াটি তাঁর খোদাপ্রেম ও বিনয়াবনত হৃদয়ের অনুভূতিকে তুলে ধরে চমৎকারভাবে। এ দোয়ার শুরুতে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত স্মরণ করে তিনি বলতেন:
'প্রভু! হে প্রভু! আপনি প্রভু, আমি দাস। দাসকে প্রভু ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি অধিপতি, আমি অধীন। অধীনকে অধিপতি ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি পরাক্রমশালী, আমি হীন-নীচ। হীন-নীচকে পরাক্রমশালী ছাড়া আর কে দয়া করবে?... আপনি স্রষ্টা, আমি সৃষ্ট। সৃষ্টকে স্রষ্টা ছাড়া আর কে দয়া করবে? ..আপনি মহামহিম বা সর্বশক্তিমান, আমি তুচ্ছ বা অপাংক্তেয়, মূল্যহীন। তুচ্ছ ও মূল্যহীনকে মহামহিম ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি সবল, আমি দুর্বল। দুর্বলকে সবল ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি ধনী, আমি দরিদ্র। দরিদ্রকে ধনী ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি দাতা, আমি প্রার্থনাকারী বা ভিক্ষুক। ভিক্ষুককে দাতা ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি চিরঞ্জীব, আমি মৃত্যুর আওতাধীন। মৃত্যু-পথযাত্রীকে চিরঞ্জীব ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি স্থায়ী, আমি ধ্বংসশীল। ধ্বংসশীলকে স্থায়ী ছাড়া আর কে দয়া করবে?'
একই মুনাজাতে আলী (আ.) আরও বলছেন:
'প্রভু! হে প্রভু! আপনি চিরস্থায়ী, আমি ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ীকে চিরস্থায়ী ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি রিজিকদাতা, আমি রিজিক-গ্রহীতা। রিজিক-গ্রহীতাকে রিজিকদাতা ছাড়া আর কে দয়া করবে? আপনি দানশীল, আমি কৃপণ। কৃপণকে দানশীল ছাড়া আর কে দয়া করবে? .. আপনি আরোগ্য-দানকারী, আমি রোগগ্রস্ত। রোগগ্রস্তকে আরোগ্য-দানকারী ছাড়া আর কে দয়া করবে? আপনি বৃহৎ, আমি ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্রকে বৃহৎ ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনি সুপথ প্রদর্শনকারী, আমি পথভ্রষ্ট। পথভ্রষ্টকে সুপথ প্রদর্শনকারী ছাড়া আর কে দয়া করবে? ..! আপনি দয়ালু, আমি দয়াগ্রহিতা। দয়াগ্রহিতাকে দয়ালু ছাড়া আর কে দয়া করবে?.....' প্রভু! হে প্রভু! আপনি গৌরবান্বিত, আমি নতজানু। নতজানুকে গৌরবান্বিত ছাড়া আর কে দয়া করবে? প্রভু! হে প্রভু! আপনার রহমতের মাধ্যমে,আপনার দান, মহানুভবতা ও কৃপার মাধ্যমে আমাকে দয়া করুন। আমার উপর সন্তুষ্ট হোন, হে দাতা, দয়ালু এবং অবারিত দানশীল ও অনুগ্রহকারী সত্তা! আপনার রহমতের মাধ্যমে, হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!'
এবারে শোনা যাক, অর্থসহ ১৯ তম রমজানের দোয়া:

পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।