বড় কি রোগ হতে পারে ভিটামিন ডি'র অভাবে
'আজকের দিনে 'ভিটামিন ডি ঘাটতি' শরীরের একটি বড় সমস্যা'
আপনি কি জানেন ভিটামিন ডি শরীরের জন্য কেন প্রয়োজন? কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই ভিটামিন ডি। এর অভাবে বড় বড় রোগ হতে পারে এবং যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে! ভিটামিন ডি ঘাটতি জনিত রোগব্যাধী এবং করণীয় নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. শাহাজাদা সেলিম বললেন' আজকের দিনে ভিটামিন ডি 'ম্যাজিক ড্রাগ'।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো
অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা, প্রযোজনা এবং সাক্ষাৎকারগ্রহণসহ উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! কেমন আছেন আপনারা। নিশ্চয়ই ভালো আছেন। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আজ থেকে আমরা কয়েক পর্বে নতুন বিষয় ভিটামিন ডি এর স্বল্পতায় যেসব রোগ্যব্যাধী হয় তা এবং করণীয় নিয়ে কথা বলব। আর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বা বিএসএমএমইউ এর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ এর সহযোগী অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক টেক্সিলা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক।
সাক্ষাৎকারে যাওয়ার আগে ভিটামিন ডি সম্পর্কে দুটো কথা বলে রাখি। মানুষের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো ভিটামিন 'ডি'। ভিটামিন 'ডি' অস্থি ও দাঁতের কাঠামো গঠন করে। অন্ত্রে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়ায়, রক্ত প্রবাহে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ভিটামিন ডি মানবদেহের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর অভাবে নানাধরণের রোগ হতে পারে এবং তা কখনও কখনও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তো চলুন ভিটামিন ডি ঘাটতি সম্পর্কিত প্রথম পর্বের আলোচনায় যাওয়া যাক।
অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম, রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
ডা. শাহজাদা সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা.শাহাজাদা সেলিম, আমরা তো বহুরকম ভিটামিনের কথা জানি বা শুনি। তবে ভিটামিন 'ডি' এর কথা প্রায়ই শুনি। আপনারা চিকিৎসকরা রোগীকে প্রায়শ ভিটামিন ডি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তো এই ভিটামিন ডি সম্পর্কে যে পরামর্শ দিচ্ছেন এর যৌক্তিক কারণ কি?
অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: জ্বি আপনি ঠিকই বলেছেন। সাম্প্রতিকালে আমরা যারা হরমোন বিশেষজ্ঞ, মেটাবলিক ডিজিজ নিয়ে কাজ করি তাঁরা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই কিন্তু ভিটামিন 'ডি' এর মাত্রা সম্পর্কে খুবই সচেতন। এর অবশ্য যৌক্তিক কারণ আছে। কারণটি হলো ভিটামিন'ডি' এখনও এমনই একটি অবস্থায় রয়েছে সেটিকে ম্যাজিক ড্রাগ বলা হয়। সেই আগে যেমন অ্যাসপিরিনকে ম্যাজিক ড্রাগ বলতাম, মেটফর্মিনকেও ম্যাজিক ড্রাগ বলি। কারণ হলো শরীরবৃত্তিয় অনেকগুলো ঘটনার সাথে 'ভিটামিন ডি' সম্পৃক্ত। 'ভিটামিন ডি' এর ঘাটতির ফলে অনেকরকম সমস্যা হতে পারে। যদি 'ভিটামিন ডি'ঠিক মতো থাকে শরীরে তাহলে নানারকম জটিল রোগের হাত থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম, ভিটামিন 'ডি'এর অভাবে কি কি রোগ হতে পারে?
অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: দেখুন, ভিটামিন 'ডি' এর অভাবে যেসব রোগ হয়ে থাকে তারমধ্যে বড় বড় কিছু রোগের নাম বলছি।
যেমন ধরুন 'ডায়াবেটিস'। যাদের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাদের মধ্যে দেখা যায় আগে থেকেই 'ভিটামিন ডি' এর ঘাটতি ছিল।
স্থূলতা: সারা বিশ্বে স্থূল রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এখানেও দেখা গেছে যারা খুব কম বয়স থেকে ভিটামিন ডি'এর ঘাটতিতে ছিলেন তারা ওজন বৃদ্ধি বা দৈহিক স্থূলতা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এটি বলছি রোগের প্রথম দিককার কথা। পরে দেখা গেল যে আলটিমেটলি তাদের হার্ট অ্যাটার্কের ঝুঁকি বেশি, স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি, মানসিক অবসাদের ঝুঁকি বেশি। এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে যাদের মধ্যে 'ভিটামিন ডি' এর ঘাটতি যত বেশি ছিল তাদেরই এইসব জটিলতাগুলো দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ভিটামিন ডি এর ঘাটতি ও করণীয় সম্পর্কে এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিমের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম স্বাস্থ্যকথার আলোচনায়। ডা.শাহজাদা সেলিম, সবচেয়ে বেশি কি ধরণের রোগ হচ্ছে বর্তমানে 'ভিটামিন ডি' এর অভাবে।
অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি এখন দেখা যাচ্ছে-বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে যারা সন্তান নিতে যাচ্ছেন অথবা সন্তান ধারণ করেছেন এ অবস্থায় যদি 'ভিটামিন ডি' এর ঘাটতি থাকে তাহলে এর প্রভাব কিন্তু গর্ভের বাচ্চার ওপর পড়বে।
আরেকটি বিষয়-প্রজননক্ষম নারীদের একটি জটিল সমস্যা। সেটি হচ্ছে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা পিসিওএস ( Polycystic ovary syndrome)। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) হল মহিলাদের মধ্যে অ্যান্ড্রোজেন (পুরুষ হরমোন) এর মাত্রা বেড়ে যাবার জন্য কিছু উপসর্গের সমাহার। এ বিষয়ে আমার নিজেরও গবেষণা আছে বাংলাদেশ থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের গবেষণা আছে এ বিষয়ে। 'ভিটামিন ডি' র ঘাটতির সাথে এই রোগটির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে যেটি পরবর্তীতে সন্তান নেবার ক্ষেত্রে একটি বাঁধা তৈরি করতে পারে।
তাহলে 'ভিটামিন ডি' এর ঘাটতিজনিত বড় বড় রোগের কথা বললাম যার সাথে মানুষের শারিরীক ও মানসিকভাবে ভালো থাকার একটি গভীর যোগাযোগ আছে।
আবার দেখা যাচ্ছে বেশি সংখ্যাক মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে- বেশি দিন বেঁচে থাকা মানুষদের মধ্যে যাদের হাঁড়ক্ষয় হচ্ছে-তার সাথেও কিন্তু সুর্নিদিষ্টভাবে ভিটামিন ডি এর সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ ভিটামিন ডি এর ঘাটতির কারণে হাঁড়ক্ষয় হয়ে থাকে।
তাহলে আমাদের জীবনের এমন কোনো দিক নেই যার সাথে 'ভিটামিন ডি' এর সম্পর্ক নেই। আর সেজন্য সকল চিকিৎসা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এখন ভিটামিন ডি এর কথা বলে থাকেন।
আর আপনি যে কোভিড ১৯ এর কথা বললেন- সে সম্পর্কে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে যাঁরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে খুব দ্রুত খারাপ অবস্থার দিকে গিয়েছিলেন-তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী যেমন ছিল একইসাথে ভিটামিন ডি এর ঘাটতিজনিত রোগীও কিন্তু ছিল। আর সেজন্য ফিনল্যান্ড শুরু থেকেই তাদের দেশের নাগরিকদের বিশেষ করে চিকিৎসকদের যারা সরাসরি কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন যাদের কোভিডে আক্রান্তের সম্ভাবনা ছিল। অথবা বয়স্ক মানুষদের কিংবা ডায়াবেটিসের রোগীদের যারা কোভিড -১৯ এ আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধের জন্য ভিটামিন ডি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন।
রেডিও তেহরান: ডা, শাহজাদা সেলিম আপনি ডায়াবেটিস, স্থূল হওয়া, মানসিক রোগ, প্রজনন সমস্যা, হাঁড়ক্ষয়সহ আরও অনেক রোগের কথা বললেন-যা ভিটামিন ডি এর অভাবে হয়। শিশুদেরও নানারকমের রোগ হচ্ছে। তো আপনি কি একটু বলবেন-কেন ভিটামিন ডি এর অভাব হয়?
অধ্যাপক ডা.শাহজাদা সেলিম: দেখুন, 'ভিটামিন ডি' এর অভাবের বিষয়টি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্নমাত্রিক সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। 'ভিটামিন ডি' যেভাবে তৈরি হয় তার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগের বেশি সূর্যের আলো থেকে আসে। সূর্যের আলো যদি ত্বকের উপরে পড়ে তাহলে ত্বকের নিচে একটা স্টেপ আছে যেখানে চর্বি থাকে। সেই চর্বিতে একটি বিশেষ ধরণের উপাদান থাকে যেখান থেকে ভিটামিন ডি তৈরি হওয়া শুরু হয়। আর এ বিষয়টি বোঝা যায় ত্বকের উপর সূর্যের আলো কীভাবে পড়ল সেটির ওপর। আসলে সূর্যের আলো বললে কিছুটা ভুল বলা হবে। আসলে সূর্যের আলোতে কি পরিমাণ আলট্রাভায়োলেট রে থাকে তার উপর নির্ভর করে কতটুকু ভিটামিন ডি তৈরি হবে। আবার ভিটামিন ডি যেহেতু ত্বকের নিচের চর্বি থেকে তৈরি হয় সেক্ষেত্রে চর্বির মাত্রাটিও একটি ফ্যাক্টর। ফলে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগেরও বেশি ভিটামিন ডি পাওয়ার উৎস হচ্ছে-সূর্যের আলো। আর শতকরা ২০ ভাগেরও কম ভিটামিন ডি পেতে পারি খাদ্য থেকে।
তো অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম- ভিটামিন ডি এর ঘাটতি নিয়ে সৃষ্ট রোগ সম্পর্কিত আলোচনার প্রথম পর্বে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ডা. শাহজাদা সেলিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আর শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! এ বিষয়ে আগামী সপ্তায় কথা হবে সে আসরেও আমাদের সাথে থাকবেন বলে আশা করছি। স্বাস্থ্যকথার আসর কেমন লাগছে, কোনো বিশেষ রোগ নিয়ে কিংবা ভিটামিন ঘাটতি সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে আপনারা জানাতে পারেন চিঠি লিখে। আমরা সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তারের পরামর্শ আপনাদের জানাব। সবাই ভালো ও সুস্থ থাকুন একামনা করে স্বাস্থ্যকথার আসর থেকে এখানেই বিদায় চাইছি।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২