এথেন্সের পুরুষরা যত খুশি স্ত্রী বা উপস্ত্রী রাখতে পারত
নারী: মানব ফুল-২ (প্রাচীন গ্রিসের নারী)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি নারী নিয়ে বিশ্বে দুই ধরনের প্রান্তিক বা চরমপন্থী চিন্তার ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে যুগে যুগে। এক শ্রেণীর মানুষ নারীকে অতি-মানুষ ও এমনকি খোদার আসনে সমাসীন করে উপাস্য বলে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। অন্য এক শ্রেণীর মানুষ নারীকে মানুষের চেয়ে নিকৃষ্ট বা পশুর সমগোত্রীয় বলে ধরে নিয়ে নারী জাতির প্রতি চরম অসম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছে।
এ দুই প্রান্তিক ধারার বিপরীতে ইসলাম নারীকে দিয়েছে ভারসাম্যপূর্ণ তথা ন্যায়নিষ্ঠ সর্বোচ্চ মর্যাদা। ইসলামে বলা হয়েছে মায়ের পায়ের নিচে রয়েছে সন্তানের বেহেশত।
মহানবী (সা) সন্তানদের ওপর মায়ের অধিকারকে পিতার অধিকারের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বলে ইঙ্গিতে উল্লেখ করেছেন। মহানবী (সা) ও আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) নারীকে সুগন্ধী ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ইসলাম-পূর্ব প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী হিসেবে বিবেচিত পারসিক বা ইরানি, রোমান, গ্রিক ও আরব জাতির মধ্যে নারী ছিল অত্যন্ত অসম্মানজনক অবস্থায়। প্রাচীন যুগে শাসক-শ্রেণীর দুই একটি ব্যতিক্রম বা নবী-পরিবারের সদস্য ও তাদের অতি অল্প-অনুসারী ছাড়া বাদবাকি মানুষের মধ্যে নারী জাতির জীবন ছিল বন্দি ও অধিকারহীন দাসীর মত।
আজ আমরা প্রাচীন গ্রীসের নারীদের শোচনীয় অবস্থার আরও কিছু দিক তুলে ধরব:
গ্রিক সভ্যতা ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৮০০ বছর আগের। খ্রিস্টের জন্মের ৭০০ বছর আগের এথেন্স শহর ছিল গ্রীসের প্রাচীনতম শহরগুলোর অন্যতম। অনেকেই মনে করেন প্রাচীন গ্রীসই হচ্ছে গণতন্ত্রের সূতিকাগার। বহু দার্শনিক জন্ম নিয়েছিলেন গ্রীসে। কিন্তু সেখানকার নারীদের অবস্থা ছিল প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতই অবহেলিত।
এথেন্সে নারী ছিল কেনাবেচার অন্যতম পণ্য। খুব কম দামেই বিক্রি করা হত তাদের। স্থাবর সম্পত্তির মত নারীদেরকেও বণ্টন করা হত পৈত্রিক সম্পদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। অবশ্য উইল বা ওসিয়ত অনুযায়ী নারীকে পৈত্রিক সম্পদের উত্তরাধিকারী নয় এমন কারো কাছে হস্তান্তর করা যেত। গ্রীক আইন অনুযায়ী নারীরা কেবলই ঘরের কাজ বা গৃহস্থালি কাজ, পুরুষদের সেবা ও সন্তান প্রতিপালন করবে। এসবের বাইরে জীবনের অন্য কোনো ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপের অধিকার রাখত না গ্রীক নারীরা। এমনকি ধনী গ্রীক পরিবারগুলোতেও রান্না-বান্না, ধোয়া-মোছা ও পানি-বহনের মত কাজে জড়িত গ্রিক দাসীরাও ঘরে থাকতে বাধ্য ছিল। চাকরি করার বা আয়-উপার্জনের কাজ ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ।
এথেন্সের সমাজে নারীর ভূমিকা ও ক্ষমতা ছিল খুবই নগণ্য। মা হওয়ার আগে কেউই তাদের কোনো গুরুত্ব দিত না! সন্তান জন্ম দেয়ার পর গ্রিক মাদেরকে নিয়ে যাওয়া হত স্বামীদের কাছে। তারা যদি সন্তানকে গ্রহণ করত তাহলেই নবজাতককে জীবিত রাখা হত। স্পার্টা অঞ্চলে এ বিষয়ে খুব কড়াকড়ি করা হত। সেখানে একটি পরিষদ নবজাতকদের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখত যে এই সন্তান বড় হলে সাহসি সৈনিক বা লাভজনক নারীতে পরিণত হবে কিনা!
এথেন্সের পুরুষরা যত খুশি স্ত্রী বা উপস্ত্রী রাখতে পারত। স্ত্রীদের তালাক নেয়াটা ছিল স্বামী বা পুরুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। কোনো পুরুষ যদি কোনো কারণে তার স্ত্রীর প্রতি অসন্তুষ্ট থাকত তাহলে একদল লোককে সাক্ষী রেখে তাকে তালাক দিত অথবা তাকে তার পরিবারের কাছে ফেরত পাঠাত এবং নারীর সঙ্গে যা যা যৌতুক হিসেবে পেয়েছিল সেসবও ফেরত দিত। তালাকের পর স্ত্রী সন্তানের ব্যাপারে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হত। এক্ষেত্রে সন্তানদের মালিক হত পিতা। স্ত্রী নিজেই যদি তালাক পেতে আগ্রহী হত সেক্ষেত্রে তাকে একজন রাজনৈতিক তথা সরকারী কর্মকর্তার সুদৃষ্টি অর্জন করতে হত।
এথেন্সের নারীরা মালিকানার অধিকারী ছিল না। সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারও তাদের ছিল না। সেখানকার নারীরা সবক্ষেত্রেই ছিল পুরুষের নিয়ন্ত্রণাধীন। এথেন্সের পুরুষরা নারীকে বিয়ে করার পর তার সব সম্পদেরও মালিক হয়ে যেত! ওই নারীকে তালাক দেয়া হলে তার সম্পদের মালিকানা চলে আসত বাবা অথবা সবচেয়ে কাছের কোনো পুরুষ আত্মীয়ের কাছে। যেসব নারীর ভাই থাকতো সেসব নারী বাবার সম্পত্তি হতে কিছুই পেত না। আর যদি কোনো নারীর কোনো ভাই না থাকতো তাহলে তার পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক হত স্বামী যা যৌতুকের মতই নিয়ে নেয়া হত। স্বামীর ঘর থেকে সেসব সম্পদের কিছুই নিজের ইচ্ছায় ভোগ করার বা বিক্রির অধিকার ছিল না নারীর! এথেন্সের সমাজ ছিল কৃষি-ভিত্তিক। এই সমাজের প্রত্যেক সদস্যই নির্দিষ্ট সম্পদের অধিকারী ছিল, কিন্তু নারীরা জমি বা কৃষি ক্ষেত্রের মালিক হতে পারত না। মেয়ে সন্তানরা পরিবারের বা স্বামীর সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হত। পরিবারগুলোর জন্য নারী নয় বরং পুরুষ সন্তান থাকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ যাতে তারা সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারে।
এথেন্সের নারীরা সামাজিক কোনো বিষয়ে মতামত দেয়ার অধিকার রাখত না। সমাজ পরিচালনায়ও তাদের কোনো অধিকার ছিল না। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দর্শক হওয়ার অধিকারও তাদের ছিল না! কারণ এ প্রতিযোগিতায় পুরুষরা নগ্ন হয়ে অংশ নিত। অবশ্য এথেন্সের বিবাহিত নারীরা ধর্মীয় উৎসব ও শোক-অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারত। থেসমোফোরিয়া নামক এক ধর্মীয় উৎসবে পুরুষদের অংশগ্রহণ ছিল নিষিদ্ধ। এ অনুষ্ঠানে নারীরা খোদা বা দেবতাগুলোর উদ্দেশ্যে নানা উপহার বা কুরবানির আয়োজন করত। এথেন্সের ধর্মীয় জীবনে নারীদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। পুরুষদের দাফন বা শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেরও আয়োজক হত এথেন্সের নারীরা। এসব অনুষ্ঠানে নারীরা মদ ছিটিয়ে দিত। দাফনের যাত্রা অনুষ্ঠান বা শোক-যাত্রা অনুষ্ঠানে নারীরা পুরুষদের আগে থাকত। এটাই একমাত্র অনুষ্ঠান যেখানে নারীরা পুরুষের আগে থাকার অধিকার পেত। মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর তিন ও নয় দিন পর যেসব শোকানুষ্ঠান হত সেসবে নারীরা কবর-নির্মাতাদের খাবার ও মদের ব্যবস্থা করত। নারীদের আচরণ এবং পোশাক বা বেশভূষার শৃঙ্খলা রক্ষার ওপর নজরদারির আইন করা হয়েছিল বিশেষ সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।
এথেন্সের পুরুষদের দৃষ্টিতে স্ত্রী রাখার একমাত্র লাভজনক দিক হল তারা পুত্র সন্তান জন্ম দেয়। তারা পুরুষ সন্তান জন্ম দিলে জয়তুন পাতার তৈরি মুকুট ঘরের কাছে রাখা হত ও তা নিয়ে গৌরব করা হত। কিন্তু কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তাদের মন খারাপ হয়ে পড়ত ও কন্যার পিতা নিজেকের জনগণের কাছ থেকে আড়াল করে রাখতেন। প্রাচীন গ্রীসে কন্যা সন্তানকে বোঝা বলে মনে করা হত। অন্যদিকে পুত্র সন্তান ক্ষমতা ও যোদ্ধার প্রতীক হিসেবে হত মহাসমাদরে সমাদৃত।
সিমোনিড্স নামের একজন এথেন্সবাসী লেখক নারীদেরকে মানুষের আকৃতিবিশিষ্ট পশু ও অশান্তির উৎস বলে উল্লেখ করেছিলেন! তার মতে নারীরা যৌন প্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখতে পারে না এবং তাদের এই প্রবৃত্তি সীমিত থাকা উচিত ছিল তাদের স্বার্থেই। এই লেখক মনে করতেন নারীরা পুরুষের যৌন শক্তি ও শারীরিক শক্তি এবং সম্পদকে ব্যবহার করে বলে তারা সব কলুষতার উৎস! কিন্তু তাদেরকে ছাড়াও সমাজ টিকবে না! খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের নাট্যকার ও লেখক ইউরিপিডিস তার মিডা নামের বইয়ে লিখেছেন, শিশুকে যদি নারী ছাড়া জন্ম দেয়া সম্ভব হত তাহলে নারী-বিহীন মানব সমাজ সব দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেত! #
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।