ইরানি গল্প ও রূপকথা: চগুনদুজ (পর্ব-৫)
আমরা ‘চগুন দুজ’ গল্পের কয়েকটি পর্ব শুনলাম। গল্পের গত পর্বে আমরা দেখেছি সোলায়মানি আংটির কল্যাণে কী করে ইব্রাহিম শাহজাদিকে তার প্রাসাদসহ নিয়ে এলো মরুর বুকে। ইব্রাহিমের সাথে আলাপ প্রসঙ্গে শাহজাদি যখন বুঝতে পারলো আসলেই তার প্রাসাদ মরুভূমিতে চলে এসেছে-হতবাক হয়ে যায় সে। নিজের হাতে চিমটি কেটে বুঝলো-সবই বাস্তব,স্বপ্ন নয় মোটেই। সে রাতের পর কী হয় সে গল্পই শুনবো আজকের আসরে।
সে রাতের ভোর যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হলো শাহজাদির কাছে। পাখিগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। মাথার ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করলো শাহজাদির। কেন যে ঘুমটা ভাঙলো। সূর্যটা যে কেন উঠছে না। উঠলেই বা কী করবে সে-বিচিত্র ভাবনার রাত শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র সঙ্গীতের গতিতে গড়ালো ভোরের দিকে।
এদিকে বাদশার প্রাসাদে ভোর নেমে আসতেই যথারীতি শাহজাদির প্রাসাদ ঘিরে যেসব দোকানপাট ছিল সেগুলো খুলতে এলো ব্যবসায়ীরা। দোকান খুলবে কি! দোকানদারেরা প্রাসাদের জায়গায় বিশাল গর্ত দেখে চোখ কপালে তুলে ফেললো। সবার চোখে নীরব হা করা জিজ্ঞাসা: শাহজাদির প্রাসাদ গেল কোথায়! কেউ কিছু ভেবে উঠতে পারছিল না। কজন দৌড়ে গেল বাদশার প্রাসাদে খবর দিতে: ‘বাদশাহ হুজুর! আপনার কন্যা তার প্রাসাদসহ হাওয়া। সেখানে বিশাল এক গর্ত...পড়ে..আছে..হুজুর’!
বাদশাহ তো নির্বাক..! কী বলবে ভাবতেও পারছে না এতো বড়ো প্রাসাদ হাওয়া..! কে, কীভাবে কোথায় নিয়ে গেল প্রাসাদ..!
লোকজনকে কিছু না বলে ঢোল পেটানো ঘোষকদের ডেকে বললো: ‘ঘোষণা করে দাও..! যে শাহজাদি কিংবা তার প্রাসাদের খোঁজ দিতে পারবে, সে যা চাইবে তাকে তাই দেওয়া হবে’।
ঘোষকের দল দিবারাত্র সবখানে ঘোষণা করে দিলো। শহর-নগর, পাড়া-মহল্লা,অলি-গলি,হাট-বাজার কোনো স্থানই বাকি রাখলো না।
ঘোষণা যার কানেই গেলো আশ্চর্য হলো। প্রাসাদ বলে কথা! সুঁই তো নয় যে আঙুলের মাথায় তুলে নিয়ে যাবে! না, কিছুতেই কোনো খবর এলো না। হাওয়াই হয়ে গেল যেন। বাদশাহর তো ভ্রু-কুঞ্চন থামে না কিছুতেই। প্রাসাদসুদ্ধ শাহজাদি গায়েব! কোথায় আছে,কীভাবে আছে..! কখোন সেও গায়েব হয়ে যায়, কে জানে!
বাদশাহর এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার ভেতর প্রাসাদে এলো এক বুড়ি। বুড়ি বাদশাকে বললো:
‘এমন একটা সিন্দুক বানাও যাকে আকাশে ওড়ানো যায়! ওই সিন্দুক তোমার কন্যা এবং প্রাসাদ ফিরিয়ে আনবে যেখানে ছিল সেখানে’।
বাদশাহ বুড়ির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আদেশ দিলো: ‘শহরের সেরা দক্ষ কার্পেন্টারকে খবর দাও’।
পেয়াদারা দ্রুত চলে গেল শহরে এবং কাঠ মিস্ত্রির কাজে সুনিপুণ কজনকে নিয়ে এলো বাদশার কাছে। বাদশা তাদেরকে বললো:
‘এই বুড়ি যে রকম বাক্স তৈরি করতে বলে হুবহু সেরকম বাক্স তৈরি করে দাও! যদি সেরকম বানাতে না পারো তাহলে তোমাদের জানটা চলে যাবে,জানের সঙ্গে মালও’।
কার্পেন্টাররা বাদশাহর আদেশ শুনে কাচুমাচু হয়ে রইলো এবং একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলে নিলো। বাদশাহকে তো আর ‘না’ বলা যাবে না। অগত্যা বলতেই হলো: ‘জি হুজুর! বানিয়ে দেবো! একদম শোঁ শোঁ করে উড়ে যাবে শূন্যে, মুক্ত বাতাসে...! জি’!
বলে তো ফেলেছে,কিন্তু কীভাবে এখন উড়ন্ত বাক্স বানাবে..! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল মিস্ত্রিরা। সবাই একত্রে বসে পরামর্শ করে অবশেষে বাক্স একটা বানিয়েছে ঠিকই। উড়বে কিনা কে জানে! বাক্স আবার ওড়ে কীভাবে! বাক্স যেরকম বানাতে বলেছে বুড়ি সেরকমই বানিয়েছে তারা। উড়বে কিনা সেটা বুড়িই বলতে পারবে। পাগলি বুড়ি! শেষ জীবনে এসেও যেভাবে জ্বালাতন করছে, সারাটা জীবন না জানি কী করেছে,খোদাই ভালো জানেন। তাদের বানানো চমৎকার বাক্সটা নিয়ে গেল বাদশার কাছে।
বাদশাহ বুড়িকে ডেকে বাক্সটা দেখালো। বুড়ি কপাল আর গালে ভাঁজ তুলে চোখ বড়ো করে দেখলো বাক্সটা। কিছুই না বলে একবার মিস্ত্রিদের দিকে তাকালো আরেকবার বাদশাহর দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর বাক্সের ভেতর ঢুকে বসে পড়লো। মিস্ত্রিদের বুকের ভেতর ধুক ধুক শব্দ রেলের যাত্রা শুরু থেকে ছুটে চলার মতো বাড়তে লাগলো। বাদশাহ নিজেও তাকিয়ে আছে বাক্সের দিকে। কৌতূহলী গম্ভীর দৃষ্টি তার। সবার দৃষ্টিতে বিভ্রম ঘটিয়ে দিয়ে ওই কাঠের বাক্স পাখির মতো উড়ে গেল শূন্যে। রানওয়ে ছাড়াই ডাইরেক্ট টেক-অফ। মিস্ত্রিদের দৃষ্টি সেই বাক্সের চলে যাওয়ার দিকে। তাদের মুখ হা। বাদশাহর দৃষ্টি এবার শূন্য থেকে নেমে এসে প্যান করলো মিস্ত্রিদের ওপর। মুখে তার মৃদু হাসি। মিস্ত্রিরাও গর্বের সাথে তাকালো বাদশাহর দিকে। ভাবখানা এমন যেন উড়ন্ত বাক্স তৈরি করা তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না।
উড়ন্ত বাক্সযানে বসে বুড়ি চারদিকে তাকাতে লাগলো ঈগলের মতো। পাহাড়-পর্বত,বন-জঙ্গল,নদী-নালা,খাল-বিল, উঁচু-নীচু, সমতলভূমি থেকে শুরু করে উষর মরুপ্রান্তর কোনো কিছুই আর বাদ রাখে নি ঘুরে দেখার। কোত্থাও খুঁজে পাওয়া গেল না শাহজাদিকে কিংবা তার প্রাসাদ। বাদশাহকে বলামাত্রই বাক্স বানিয়ে দিয়েছে,এখন খালি হাতে ফিরলে তো চলবে না। তাছাড়া বাদশাকে বুড়ি বলেছে ওই বাক্সই ফিরিয়ে আনবে শাহজাদিকে। কোন মুখে ফিরবে বুড়ি! শাহজাদিকে ছাড়া ফেরা দায়। বুড়ি এসব ভাবতে ভাবতে তাকাচ্ছিলো চারদিকে। হঠাৎ দূর থেকে তার দৃষ্টিতে পড়লো মধ্যমরুতে একটি ঘরের মতো কিছু একটা।
বাক্স নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সেদিকে। যেতেই বুড়ির মনে হলো একটা প্রাসাদ। প্রাসাদের উপরে একটা গাছও আছে ডালপালা বিস্তীর্ণ করে। আর কিছু নেই। চারদিক বালি আর পাথুরে কণায় ভর্তি। বুড়ির ঠোঁটের কোণে মাংস ফুলে রেখায়িত হয়ে উঠলো। চীৎকার করে বললো বুড়ি:
‘পেয়ে গেছি! লক্ষ্যবিন্দুতে বিদ্ধ হয়েছে চোখের তীর! গালের তিল ছুঁয়েছে আঙুল আমার। এটা শাহজাদির প্রাসাদই হবে! হ্যাঁ, শাহজাদিরই প্রাসাদ। কোনো সন্দেহ নেই। বুড়ির বাক্স বিমান প্রাসাদের খানিকটা দূরে ল্যান্ড করলো।
তারপরের গল্প শুনবো পরবর্তী আসরে। (চলবে)
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৩১/টি-১০১.১