মার্চ ২৩, ২০১৭ ১৮:০০ Asia/Dhaka

মসজিদ হচ্ছে এমন একটি অতিথিশালা যারা মেহমানদারি করেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। এখানে তাঁর দয়া ও মহানুভবতার পরশে প্রতিটি অতিথির হৃদয় ও প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মুমিন ব্যক্তিরা এই পবিত্র স্থানে আল্লাহর বিশেষ রহমতের ছায়াতলে ইবাদতের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করেন।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, মসজিদ হচ্ছে প্রকৃত প্রেমিক মহান আল্লাহর সঙ্গে মানুষের প্রাণ ও আত্মাকে বিলিন করে দেয়ার স্থান। ঠিক এ কারণে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায় করার জন্য মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। একদিন রাসূলে খোদা (সা.) হযরত জিব্রাইল (আ.)’র কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পৃথিবীর কোন স্থান আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয়? হযরত জিব্রাইল যে উত্তরটি দিয়েছিলেন তা হলো- মসজিদ। কাজেই মসজিদ যখন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় স্থান তখন সেখানে প্রবেশ করা মাত্র যেকোনো মানুষ তাঁর দয়ার পরশে ধন্য হবে এটাই স্বাভাবিক। এ কারণে হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি ওজু করে মসজিদ প্রবেশ করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয় মহান আল্লাহ তাকে কাবা শরীফ জিয়ারতের সওয়াব দান করেন।”

তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মসজিদ গমনে ইচ্ছুক প্রতিটি মানুষকে তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী মসজিদে প্রবেশের আদব ও নিয়ম-কানুন জানতে হবে। কারণ, ধর্মীয় জ্ঞান যত বাড়ে মানুষের ইবাদতের মর্যাদাও আল্লাহর কাছে তত বেড়ে যায়। ইমাম সাদেক (আ.) এ সম্পর্কে বলেন, “যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে তখন জেনে রেখো তুমি এমন এক মহান বাদশাহ’র দরবারে উপস্থিত হয়েছো যেখানে পবিত্র-আত্মার অধিকারী ছাড়া আর কেউ যেতে পারে না, সত্যবাদী ছাড়া আর কারো সেখানে যাওয়া উচিত নয়। তাঁর সামনে নিজেকে অত্যন্ত হীন বান্দা মনে করবে এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এমন কোনো চিন্তা মাথায় আসলে তা ঝেড়ে ফেলে দেবে। কারণ, তিনি একাগ্রচিত্ত ও পবিত্র অন্তরের অধিকারী ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কবুল করেন না।”

পাহাড়ের চূড়ায় হযরত খিজির (আ.) মসজিদ, কোম, ইরান।

বিশ্বনবী (সা.) মসজিদে প্রবেশের আদব বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর অন্যতম প্রিয় সাহাবী হযরত আবু যর গিফারিকে বলেন, “ইয়া আবু যর, জেনে রেখো, যে ব্যক্তি মসজিদকে আবাদ করার জন্য চেষ্টা ও পরিশ্রম করবে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার হিসেবে রয়েছে জান্নাত।” রাসূলের কথা শুনে আবু যর প্রশ্ন করলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহর ঘরকে কীভাবে আবাদ করতে পারি?” রাসূলে খোদা (সা.) জবাবে বললেন, “মসজিদ আবাদের অর্থ হলো- এই পবিত্র স্থানে উচ্চস্বরে কথা বলবে না, বেহুদা কাজ বা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজ করবে না এবং বাতিল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে। এর কোনো একটি করলে তোমাকে কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হতে হবে।” কাজেই দেখা যাচ্ছে মসজিদে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে প্রবেশ করার পাশাপাশি সেখানে নীরবতা অবলম্বন করা জরুরি। কারো যদি একান্তই কথা বলার প্রয়োজন হয় তাহলে অতি নীচু স্বরে বলতে হবে যাতে অন্যের ইবাদতের ক্ষতি না হয়।

পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত আসরে আমরা মসজিদুল হারাম সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজও এই মসজিদ সম্পর্কে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেব। ইতিহাসে এসেছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের ছেলে হযরত ইসমাইলকে সঙ্গে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেন। এক পর্যায়ে এর দেয়াল যখন উঁচু হয়ে যায় তখন তার উপরে আর নাগাল পাচ্ছিলেন না আল্লাহর এই নবী। এ অবস্থায় হযরত ইসমাইল (আ.) একটি উঁচু পাথর এনে দেয়ালের পাশে বসিয়ে দেন যাতে তার উপরে দাঁড়িয়ে হযতর ইব্রাহিম নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। এই পাথরটি বারবার একস্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে কাবাঘর নির্মাণ করতে থাকেন আল্লাহর এই নবী। পাথরটির উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে তার উপর হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র পায়ের ছাপ পড়ে যায়। কাবাঘরের পাশে হযরত ইব্রাহিমের পায়ের ছাপ সম্বলিত সেই পাথরটি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। ইতিহাসে এটি মাকামে ইব্রাহিম নামেই পরিচিত। বর্গাকৃত্তি এই পাথরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ সেন্টিমিটার এবং উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার।

আব্বাসীয় তৃতীয় খলিফা মেহদি আব্বাসের শাসনামলে এই পাথরকে স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি একটি বড় খাঁচার মধ্যে এটিকে সংরক্ষণ করা হয়। এই খাঁচাটি মসজিদুল হারামের অনেকখানি জায়গা দখল করে আছে বলে ১৯৬৫ সালে এটি ভেঙে ফেলে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি কাঠামোর মধ্যে পাথরটিকে রাখা হয়। মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে বলেন, “ যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর (বললাম) তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও...।” মসজিদুল হারামের পাশে মাকামে ইব্রাহিমের অবস্থান আল্লাহর ঘর জিয়ারতকারী প্রতিটি মানুষকে মহান আল্লাহর কাছে হযরত ইব্রাহিম (আ.)’র অতি উচ্চ মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহর প্রকৃত খলিফার মর্যাদা অর্জনের জন্য প্রতিটি মুমিন মুসলমান এই মাকামে ইব্রাহিম থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে।

‘হাজরে আসওয়াদ’ বা কালো পাথর

কাবা শরিফের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আরেকটি অংশ হচ্ছে ‘হাজরে আসওয়াদ’ পাথর। উপবৃত্তাকার কালো রঙের প্রায় ৫০ সেন্টিমিটার আয়তনের পাথরটি রূপার তৈরি একটি ফ্রেমের মধ্যে সংরক্ষিত আছে। হজের সময় হাজিরা এই পাথরের সামনে থেকে তাদের তাওয়াফ শুরু করেন এবং কাবাশরিফকে সাতবার প্রদক্ষিণের পর এই পাথরের সামনে এসে তাওয়াফ শেষ করেন। এরপর তারা এই পাথরটি স্পর্শ করেন এবং চুমু খান। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এই হাজরে আসওয়াদ পাথর। এটি স্পর্শ করার মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শপথ পুনর্ব্যক্ত করে।

হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবাশরিফ নির্মাণের পর এই পাথরকে এই কাবাঘরের পূর্ব পাশে স্থাপন করেছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) যখন এই মসজিদ পুনঃস্থাপন করেন তখন হাজরে আসওয়াদ পার্শ্ববর্তী আবুকুবাইস পাহাড়ে পড়েছিল। হযরত ইব্রাহিম পাথরটি উঠিয়ে তার আগের জায়গায় স্থাপন করেন। ওই ঘটনার কয়েকশ’ বছর পর বিশ্বনবী (সা.)’র বয়স যখন ৩৫ বছর তখন প্রবল বর্ষণ ও বন্যায় কাবা শরিফের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তখনো নবুওয়াত লাভ না করলেও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে কুরাইশদের কাছে আল-আমিন নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কাবা পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে কুরাইশ বংশের চারটি গোত্রের লোকজন হাজরে আসওয়াদকে নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। কোন্ গোত্রের মানুষের হাতে এই মূল্যবান পাথর কাবা শরীফে স্থাপিত হবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয় এই দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি চাদরের উপর পাথরটি উঠিয়ে চার গোত্রের চারজনকে চাদরটির চারকোন ধরে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তিনি নিজের হাতে পাথরটি জায়গামতো বসিয়ে দেন। এভাবেই নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেই একটি মহান কাজ বিশ্বনবীর (সা.) হাতে সম্পন্ন হয়।  

‘হিজরে ইসমাইল’ হচ্ছে আল্লাহর ঘরের আরেকটি মূল্যবান অংশ। এটি কাবা শরীফের সঙ্গে লাগানো একটি উন্মুক্ত স্থান যা অর্ধবৃত্তাকার একটি দেয়াল দিয়ে ঘেরা। কোনো কোনো সূত্রমতে, এখানে হযরত ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মা বিবি হাজেরা বসবাস করতেন এবং তারা মারা গেলে তাদেরকে এখানেই দাফন করা হয়।

বিশ্বনবী (সা.)’র একজন স্ত্রী থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি একবার কাবাঘরে ভেতরে প্রবেশ করে নামাজ আদায় করতে চাইলাম। মহানবী (সা.) আমাকে হাত ধরে হিজরে ইসমাইলের মধ্যে নিয়ে যান এবং বলেন, “যখন তোমার কাবাঘরে নামাজ পড়তে ইচ্ছে হবে তখন এখানে এসে নামাজ আদায় করবে; কারণ এটি কাবারই অংশ। কিন্তু তোমার গোত্রের লোকেরা কাবাঘর পুনর্নিমাণের সময় এটিকে এই ঘরের বাইরে রেখে দেয়।” 

রাসূলুল্লাহ (সা.)’র এই হাদিসের সূত্র ধরে ফকীহগণ রায় দিয়েছেন হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা পালনের সময় হিজরে ইসমাইলের ভেতর দিয়ে হাঁটা যাবে না বরং এটিসহ কাবাঘরকে তাওয়াফ করতে হবে। বর্তমানে হিজরে ইসমাইলের দেয়ালের উচ্চতা ১.৩২ মিটার, এর ব্যাসার্ধ ৫.৮ মিটার এবং কাবাশরীফ থেকে এই দেয়ালের দূরত্ব ২.২২ মিটার।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/২৩