মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১৩
ইসলামী সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গণগ্রন্থাগারগুলোর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। এগুলোকে তখন ‘দারুল এল্ম' বলে অভিহিত করা হতো। হিজরী চতুর্থ শতকে দারুল এলমগুলোর প্রতিষ্ঠা শুরু হতে থাকে। এগুলোই ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের গ্রন্থাগার।
ইসলামের আবির্ভাবের পর জ্ঞানের বিকাশের প্রয়োজণীয়তা দেখা দেয় কেননা ইসলাম হচ্ছে জ্ঞান ভিত্তিক একটি ধর্ম। তারই প্রয়োজনে লাইব্রেরিগুলো গড়ে ওঠে। লাইব্রেরি মানেই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। ফাতেমিয়ান দারুল এলমটিও তেমনি একটি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। হিজরী ৩৯৫ সালে কায়রোতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। এখানে গণিতসহ প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দেওয়া হতো। এখানে একটি লাইব্রেরিও ছিল যাতে দশ লাখেরও বেশি বই ছিল। মোসেল দারুল এলমটিও ছিল আরো একটি বিখ্যাত লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিটিতে জ্ঞানের প্রায় সকল বিষয়েরই বইয়ের সংগ্রহ ছিল। ত্রিপলি দারুল এলম, বাগদাদ দারুল এলম, বায়তুল মোকাদ্দাস দারুল এলম প্রভৃতিও মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে স্বনামখ্যাত ছিল। এসব দারুল এলমের প্রত্যেকটিতেই হাজার হাজার বইয়ের সংগ্রহ ছিল। যার ফলে বহু গবেষক, লেখক এসব প্রতিষ্ঠানে এসে গবেষণা করতেন, লেখালেখি করতেন।
দারুল এলমের পাশাপাশি আরো এক ধরনের জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো,এগুলো নেজামিয়া নামে পরিচিত ছিল। হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে সেলজুকি শাসনামলের মন্ত্রী খাজা নিযামুল মুলক বাগদাদ এবং নিশাবুরসহ আরো অনেক শহরে নিজামিয়া নামে অসংখ্য মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। এইসব নেজামিয়া বর্তমান যুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এইসব নেজামিয়া স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতায় উচ্চ শিক্ষাকে উন্নত পর্যায়ে বা পূর্ণতায় পৌঁছার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। হিজরী ৪৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ নেজামিয়াটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ নেজামিয়াগুলোর একটি। আবু ইসহাক শিরাজির মতো মহান মনীষী এখানে পাঠদান করতেন। এক সময় গাযযালির মতো মুসলিম দার্শনিকও এই বিশ্ববিধ্যালয়ে ছাত্রদের ক্লাস নেন এবং তারপর থেকে মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের মাদ্রাসা বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
বাগদাদ নেজামিয়ার গ্রন্থাগার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম গ্রন্থাগার ছিল এবং যশ-খ্যাতি ও সমৃদ্ধির দিক থেকে এই গ্রন্থাগারটির গর্ব করার মতো সংক্ষিপ্ত একটি দিনপঞ্জী বা ইতিহাসও রয়েছে। নিজামুল মুলক এই গ্রন্থাগারগুলো নির্মাণ করেছেন এভং তিনি নিজেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বা দেখাশোনা করতেন। তিনি বাগদাদ নেজামিয়াটি পরিদর্শন করতে গিয়ে ছোট্ট একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। সুখের বিষয় হচ্ছে এই গ্রন্থাগারটির পরিচালনা কিংবা প্রশাসনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ইতিহাসের অংশবিশেষ এখনো সংরক্ষিত আছে। সেলজুকি শাসনামলে বিশেষ করে নিযামুল মুলকের আদেশে এইসব নেজামিয়া বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার এইসব প্রতিষ্ঠান নেজামিয়া নামে পরিচিতি ও খ্যাতি পায়। বাগদাদ নেজামিয়াতে শিক্ষকদের বাসভবন ছাড়াও মসজিদ এবং গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা ছিল। যারফলে একটা বিশাল অঙ্গন জুড়ে গড়ে উঠতো নেজামিয়াগুলো। এখানে তাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও বিশেষ করে ওয়াজের মজলিশ, ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে যুক্তি-তর্কের আসর ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। এসবের কারণে বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল নেজামিয়াগুলো।
ধর্মীয় ব্যাপারে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতেন বলে তিনি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাগদাদের দারুল খোলাফাকে ধর্মীয় বিশ্বাস বিষয়ক মত বিনিময় কেন্দ্রে পরিণত করবেন। তাই তিনি বাগদাদ নেজামিয়াকে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। এগুলোর পাশাপাশি খোরাসান এবং ইরাকের বিভিন্ন শহরেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাগদাদ নেজামিয়া প্রতিষ্ঠালগ্নে শাফেয়ি ফিকাহ, হাদিস এবং কোরআন অধ্যয়ন ইত্যাদি বিষয়ই ছিল সেখানকার পাঠ্যতালিকায়। পরে ধীরে ধীরে তার সাথে যুক্ত হয় উসুলে ফিকা, তাফসির, কোরআন শিক্ষা, এলমে কালাম, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যসহ আরো অনেক বিষয়। খাজা নিযামুল মুলকের উপদেশ নামক গ্রন্থের লেখক বাগদাদ নেজামিয়ায় যেসব মহান মনীষীগণ শিক্ষকতা করেছেন তাঁদের ৮৫ জনের নামের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কয়েকজন বিখ্যাত শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা যায় যেমনঃ আবু আব্দুল্লাহ তাবারি, আবু হামেদ মোহাম্মাদ গাযযালি এবং আবু মুহাম্মাদ খাওয়ারেযমি।
নিশাবুর শহরের ওপর সেলজুকি বাদশা খাজা নিযামুল মুলকের বিশেষ দৃষ্টি থাকার কারণে এই শহরটিও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম, ইমাম মোয়াফফাক নিশাবুরি, ইমামুল হারামাইন জুয়িনি, আত্তার নিশাবুরি প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষীগণ এই নিশাবুরেই গড়ে ওঠেন। অসংখ্য মনীষী থাকার কারণে এই নিশাবুরেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি নেজামিয়া। এই নিজামিয়াতেও অসংখ্য স্বনামধন্য মনীষী শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। মানের দিক থেকে নিশাবুর নেজামিয়াটিকে বাগদাদের পরই স্থান দেওয়া হয়। ইস্ফাহান নিজামিয়াও খাযা নিযামুল মুলকেরই নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক নামকরা জ্ঞানী গুণী মনীষী শিক্ষকতা করেছেন। যাদেঁর মধ্যে আবু বকর মোঃ বিন সাবেত খোজান্দি এবং ফখরুদ্দিন আবুল মায়ালি ভেরকানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই মহান প্রতিষ্ঠানটির কারণে ইস্ফাহান অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল।
বালখ নেজামিয়াটিতেও আদম বিন আসাদ সোহরাওয়ার্দির মতো শিক্ষক এবং রাশিদ ভাতভতের মতো ছাত্র থাকায় প্রতিষ্ঠানটি বেশ নাম করেছিল। বসরা নেজামিয়াও কম খ্যাতিময় ছিল না। বসরা নেজামিয়া নামের বিশ্ববিদ্যালয়টি বাগদাদ নেজামিয়ার চেয়েও বড়ো এবং বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং একই নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান বসরার উত্তরাঞ্চলে গড়ে ওঠে। অনরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয় বায়তুল মোকাদ্দাসে গড়ে তুলেছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী।্এভাবে মুসলিম ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ধারা অব্যাহত থাকে। দজলার তীরে বাগদাদের মোস্তানসারিয়া মাদ্রাসা, মধ্য্এশিয়ার মাদ্রাসার মধ্যে সমরকন্দ্ মাদ্রাসার নাম উল্লেখ করার মতো। সাফাভি বাদশাদের আদেশেও আরো কয়েকটি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। যেমন ইস্ফাহানের চাহারবাগ মাদ্রাসা এবং শিরাযের খান মাদ্রাসা। এখানে ইরানের বিখ্যাত দার্শনিক মোল্লা সাদরাও শিক্ষকতা করেছিলেন। মধ্য যুগের শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ধারা আরো বেশি গতিময় হয়ে ওঠে।
এগারশ' বছর আগে মরক্কোর ফাস শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় কারভিন মাদ্রাসা। এটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কায়রোর আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটিও এই তালিকার অগ্রভাগে উঠে আসবে। কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠানটি তার প্রথম সহস্র বার্ষিকী উদযাপন করেছে। ইরাকের নাজাফে হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে গড়ে উঠেছিল ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র। এটি এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এভাবেই ইসলামী সভ্যতা বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা পালন করে এসেছে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/৩১