আগস্ট ১৩, ২০১৭ ২১:১১ Asia/Dhaka
  • মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি-১৭

গত কয়েকটি আসরে আমরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদানের সংক্ষিপ্ত অথচ ঐতিহাসিক কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদির পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা কিংবা মেকানিকসেও মুসলিম মনীষীদের ব্যাপক অবদান থাকলেও সেগুলো খুব একটা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয় নি।

তাই আজকের আসরে মেকানিক্স বা যন্ত্রকৌশল বিষয়ে মুসলমানদের অবদান নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।

যন্ত্রকৌশলবিদ্যা বিভিন্ন রকম সরঞ্জামাদি বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার পদ্ধতি সংক্রান্ত বিদ্যা। আধুনিককালের যন্ত্রকৌশলবিদ্যার সাথে আগেকার সেই মেকানিক্সের নিকট সম্পর্ক রয়েছে। মুসলমান বিজ্ঞানীদের কাছে জ্ঞানের স্তর বিন্যাসে মেকানিকও গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, মিউজিক ইত্যাদির মতোই বিদ্যার আলাদা একটি শাখা হিসেবে বিবেচিত ছিল।

ক্রুসেড যুদ্ধ ছিল বিভিন্ন সভ্যতার মাঝে জ্ঞান ও বিদ্যার বিনিময় বিশেষ করে যন্ত্রকৌশলবিদ্যা এবং কারিগরী বিদ্যা মুসলমানদের কাছ থেকে পাশ্চাত্যে যাবার একটি প্রধান কারণ। যন্ত্রকৌশলবিদ্যার ক্ষেত্রে যেসব বইপুস্তক মুসলিম বিজ্ঞানীগণ লিখেছেন সেসব খুব কমই ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছিল। তবে ক্রুসেড যুদ্ধের সময় পাশ্চাত্য মুসলিম বিজ্ঞানীদের ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে বিস্মিত হয়। মুসলমানরা স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি, ভারি মালামাল উত্তোলন করার বিভিন্ন যন্ত্রসহ বিভিন্ন রকমের সামরিক সরঞ্জাম থৈরি করেছিল। যন্ত্রকৌশলবিদ্যায় কী রকম অগ্রগতি মুসলিম বিজ্ঞানীগণ অর্জন করেছিলেন এসব তার ক্ষুদ্র প্রমাণ।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুসলমান প্রকৌশলীগণ মধ্যপ্রাচ্য এবং মেডিটেরিয়ান অঞ্চলের বিজ্ঞানীদের প্রকৌশলগত অর্জন থেকে প্রভাবিত হয়ে থাকবে। মিশরীয় এবং রোমানরা যন্ত্রকৌশলে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছিল তবে সবার চেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছিল গ্রিস। আব্বাসীয় খেলাফতের সময় গ্রিক ভাষা এবং সুরিয়ানী ভাষার বহু বই আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। সে সময় মুসলমানদের হাতে জলঘড়ির প্রযুক্তির ওপর একটি বই ছিল। মুসলিম বিজ্ঞানী জাযারি এই বইটিকে যন্ত্রকৌশল বিদ্যার অন্যতম একটি উৎস বলে মনে করেন।

বদিউযযামান জাযারি ছিলেন প্রাচীন আমলে মুসলমান যন্ত্রকৌশল বিজ্ঞানীদের মধ্যে খুবই খ্যাতিমান। হিজরী ষষ্ঠ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে এবং সপ্তম শতাব্দির প্রথমার্ধের শুরুতে তুরস্কের দিয়ারবাক্‌র শহরে বাস করতেন। জাযারি দিয়ারবাকরের শাসক মালেক সালেহর আহ্বানে তাঁর লেখা যন্ত্রকৌশল বিষয়ক এই বইটি লিখেছিলেন। যন্ত্রকৌশল বিদ্যায় তাঁর এই লেখা এ বইটি সমকালীন গবেষক বা জ্ঞানীদের মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং তাকে প্রকৌশলীদের প্রধান উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে তিনি ব্যাপক দক্ষ ছিলেন বলেই এ ধরনের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। জাযারি তার কাজের ব্যাপরে ভীষণ মেধা এবং সৃজনশীলতার অধিকারী ছিলেন। অত্যন্ত জটিল সরঞ্জামাদির ব্যাপারেও তিনি একেবারে যথার্থ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যাখ্যা দিতেন। মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতার ওপর তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন।

অভিজ্ঞতাহীন কোনো জ্ঞানকে তিনি গ্রহণ করতে চাইতেন না। মেসোপটেমিয়া, ভারত এবং ইরানের সভ্যতাগুলোর মতো ইসলামপূর্ব সভ্যতায় মুসলমান প্রকৌশলীদের আবিষ্কার ও নতুন নতুন উদ্ভাবনীগুলোর মাঝে জাযারির আবিষ্কার গ্রন্থিত মালার ছোট্ট একটি বৃত্তের মতো। মুসলিম এই বিজ্ঞানীর একটি বই আছে ‘আল-জামেউ বাইনাল এলমি ওয়াল আমাল,আন-নাফেউ ফি সানাআতিল হিয়াল' নামে। তাঁর এই বইটি আগেকার যুগে হাইডরেোলিক ও মেকানিক্যাল সরঞ্জামাদি সম্পর্কে জানার ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো একটি বই ছিল। এ বইটিতে থিউরি এবং ব্যবহারিক পদ্ধতির মাঝে এক ধরনের মিল লক্ষ্য করা যায়। বিংশ শতাব্দির প্রথম কয়েক দশকে জার্মানীর বিখ্যাত দুই গণিতবিদ এ্ই বইটির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এবং এ বইয়ের কিছু কিছু অংশ তাঁরা তাদেঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিবেদনে অনুবাদও করেন, উদ্ধৃতও করেন। এদের একজন হলেন বিদম্যান এভং অপরজন হাউজার।

পরবর্তীকালে অবশ্য জাযারির বইগুলো ডোনাল্ড হেইলের মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয় এবং বই আকারে প্রকাশিত হয়। এরপর আহমাদ ইউসুফ আল হাসান নামে সিরীয় এক মনীষী ১৯৭৯ সালে জাযারির পুর্ণাঙ্গ বইটিকে আরবি থেকে সিরিয়ার ভাষায় অনুবাদ করেন। উল্লেখ করা যায় যে জাযারির বইটির ফার্সি সংস্করণ এখনো তেহরানের শহীদ মোতাহহারী হাইস্কুলের লাইে্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।

জাযারির বিখ্যাত বইটি মেকানিক্যাল বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দিক থেকে খুব্ই মূল্যবান একটি বই হিসেবে স্বীকৃত। সত্যিই ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত জাযারির গবেষণা এবং উদ্ভাবনীগুলোর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।

বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক মহান ইতিহাসবিদ জর্জ শার্টুন জাযারির বই সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ একটি বই এটি। যন্ত্রকৌশলবিদ্যা সংক্রান্ত বিশেষ করে যন্ত্র পরিচিতি ও তার বিশদ ব্যাখ্যা সম্পর্কে মুসলমানদের একটি শ্রেষ্ঠ বই এটি।' জাযারি যে-কোনো শিল্প সরঞ্জাম তৈরির পদ্ধতি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বইতে, আজকের যুগের শিল্পস্রষ্টারাও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে যে-কোনো সরঞ্জাম খুব সহজেই তৈরি করতে পারেন। যন্ত্রকৌশলবিদ্যার বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন জাযারি এমন একটি মেশিন সম্পর্কে পুরো ডিজাইন দিয়ে গেছেন, যন্ত্রকৌশলবিদ্যার পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে যার ভূমিকা অপরিসীম।

বলা যায়, এমন বহু পার্টস এবং পদ্ধতি জাযারি ব্যবহার করেছেন, যেগুলোকে নয়া প্রকৌশল সামগ্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছুদিন আগে জাযারি প্রদত্ত ব্যাখ্যা ও পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা বেশ কিছু শিল্প-সরঞ্জাম লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিশ্ব উৎসবে পাঠানো হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে পাম্পার বা হাওয়া ঢুকানোর যন্ত্র, রক্ত নেওয়ার যন্ত্র এবং বিরাট জলঘড়ি।

ঘড়ির প্রসঙ্গ এসে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলো আজ আর আমাদের হাতে সময় নেই কথা বলার। তাই পরবর্তী আসরে যন্ত্রকৌশলবিদ্যা এবং পদার্থবিদ্যায় মুসলিম বিজ্ঞানীদের আরো কিছু অর্জন ও অবদান নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে রইলো।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/আবু সাঈদ/১৩